পার্টি লাইনের বিপক্ষে গিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন, দেখিয়েছিলেন তিনি। আপাতমস্তক বাঙালি, সবসময় ধুতি-পাঞ্জাবি এবং কোলাপুরি চপ্পলে এক বিরল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তিনি। যখন কমরেড মানেই ধরা হতো ময়লা পাঞ্জাবী, ফতুয়া ও আধপড়া বিড়ি, তখন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সবসময় থাকতেন ধোপদুরস্ত, ঝকঝকে তকতকে মেজাজে। কিন্তু ব্যক্তিগত সততার নিরিখে তিনি এক বিরল রাজনীতিক, এক প্রকৃত কমরেড। পশ্চিমবঙ্গের ১১ বছরের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও আজীবন থেকেছেন পাম অভিনিওর একচিলতে ফ্ল্যাটে। বৃহস্পতিবার তিনি প্রয়াত হলেন, বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। শেষ হল এক গৌরবময় অধ্যায়।
জন্ম উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর এলাকায়। যদিও পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিল অধুনা বাংলাদেশে। তাঁর আরও একটা পরিচয় আছে, তিনি কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভ্রাতুষ্পুত্র। ফলে পারিবারিক ঐতিহ্য ছিলই। শ্যামপুকুরের শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় থেকে পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়াশোনা। ফলে সাহিত্যের নানা ধারায় তাঁর বিচরণ ছিল অবাধ। ছাত্র জীবন থেকেই বামপন্থী মানসিকতা গড়ে ওঠে পারিবারিক ঐতিহ্য মেনে। ১৯৬৬ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সিপিএমের সদস্য হন। এর ঠিক দুই বছর আগেই সিপিআই ভেঙে জন্ম হয়েছে সিপিএমের। ফলে বামপন্থার নতুন শাখায় তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়তে সময় লাগেনি। কারণ সেই সময় দলীয় পত্রপত্রিকা সম্পাদনা এবং লেখালিখির দায়িত্ব পেয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তবে তাঁর উত্থান কিন্তু বামপন্থার এক উল্টো ধারায় হেঁটে। যখন শৈবাল মিত্র-আজিজুল হকের মতো বামপন্থী নেতারা সশস্ত্র সংগ্রাম এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রশ্নে অন্য ধারায় আশ্রয় নিতে চাইছেন। সেই সময় সিপিএমের যুব সংগঠন গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের জন্মলগ্নে তিনি সংগঠক হিসেবে বড় দায়িত্ব পান। ষাটের দশকের শেষের দিকে ডিওয়াইএফওয়াই-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক হন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। পরবর্তী একদশক তিনি কলকাতা ও রাজ্যজুড়ে তিনি যুব সংগঠনের হয়ে প্রচারে ঝড় তোলেন। খাদ্য আন্দোলনে অংশ নেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকার বিরুদ্ধেও সক্রিয় প্রচার করেন। এরপর সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সিপিএম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য হন। এরপর সংগঠনের পাশাপাশি তাঁকে সংসদীয় রাজনীতিতে নিয়ে আসে বাম নেতৃত্ব। ১৯৭৭ সালে কাশীপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রথম নির্বাচনে জেতেন। এবং একটানা ১৯৮২ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মন্ত্রিসভায় তথ্য ও জনসংযোগ দফতরের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ছন্দপতন ১৯৮২ সালে। সেবার বিধানসভা নির্বাচনে পরাজিত হন বুদ্ধদেব। পরের নির্বাচনেই বিধানসভা কেন্দ্র বদল, কাশীপুর থেকে যাদবপুর বিধানসভায় টিকিট পান তিনি। ১৯৮৭ সালে যাদবপুর কেন্দ্র থেকেই জিতে ফের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের দায়িত্ব নেন। এরপর থেকে ওই যাদবপুর থেকেই তিনি জিতে এসেছেন রাজ্যের পালাবদল পর্যায়ে। ১৯৮৭ থেকে ২০১১ সাল, এই সময়টা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জীবন সবচেয়ে ঘটনাবহুল। এই সময়কালে তাঁর মুখ্যমন্ত্রীত্ব পাওয়া এবং যাওয়া, সবই ঘটেছে। এছাড়া আরও কিছু ঘটনা, যা রাজ্য রাজনীতির ইতিহাসেও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভায় বুদ্ধদেব তথ্য সংস্কৃতির পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র, পুর ও নগরন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতরেরও দায়িত্ব সামলেছেন। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভা থেকে তিনি আচমকা পদত্যাগ করেন। সেই সময় তাঁকে বলতে শোনা যেত, “চোরেদের মন্ত্রিসভায় থাকবো না”। এই ঘটনা নিয়ে নানা মুনির নানা মত থাকলেও সঠিক কারণ আজও জানা যায়নি। তবে মান-অভিমান বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে জ্যোতি বসুর সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী হন। এরমধ্যে তিনি সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হয়েছেন। ২০০০ সালে হন সিপিএম পলিটব্যুরোর সদস্য। ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। এরপর টানা ১১ বছর তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। এই সময়কালে অনেক উত্থান-পতন দেখেছেন তিনি। পার্টিলাইনের বিরুদ্ধে গিয়েও রাজ্যের শিল্পায়নের হয়ে সওয়াল করেছিলেন। সিঙ্গুরে দো-ফসলি জমি অধিগ্রহণ করে টাটার ন্যানো গাড়ির কারখানা স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। যা নিয়ে বহু আন্দোলন, বিতর্কের পর পতন হয় দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম জমানা। শেষ হয় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অধ্যায়ও।
Discussion about this post