ভাদ্র মাসের প্রথম অমাবস্যা তিথি তন্ত্রমতে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। হিন্দু ও বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধকদের জন্য এই তিথি খুবই পবিত্র এবং তাৎপর্যপূর্ণ। কৌশিকী অমাবস্যা তিথিকে অনেকে মা তারার আবির্ভাব তিথি বলে থাকেন। কিন্তু এই ধারণা ভুল। এই কৌশিকী অমাবস্যা তিথিতে বামদেব তাঁর সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। মা তারার আপন সন্তান হিসেবে পরিচিত বামদেব বা বামাখ্যাপা এই তিথিতেই তারাপীঠ মহাশ্মশানে স্বেত শিমুল গাছের নিচে পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে বামদেব সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। তাই তন্ত্রসাধকদের কাছে এই তিথি খুবই পবিত্র এক তিথি। বামদেব তারা মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন। মা তারার সাধনা করেই তিনি এই কৌশিকী অমাবস্যা তিথিতে স্বয়ং মায়ের দর্শন পান বলেই মত। পাশাপাশি এই বিশেষ তিথিতে সাধণা করলে সিদ্ধিলাভের সম্ভাবনা অনেক গুণ বেড়ে যায় বলেই ধারণা। এই কারণেই কৌশিকী অমাবস্যার রাতকে বলা হয় ‘তারা রাত্রি’। আসুন জেনে নেওয়া যাক এই দিনটির বিশেষ গুরুত্ব।
কৌশিকী অমাবস্যা নিয়ে বিভিন্ন ধারণা প্রচলিত আছে। আছে নানা পৌরাণিক কাহিনীও। এর মধ্যে অন্যতম কাহিনী হল দেবী কৌশিকীর জন্ম বৃত্তান্ত। শ্রী শ্রী চণ্ডীতে বর্ণিত কাহিনী অনুসারে পুরাকালে পার্বতী সতী রূপে শিবের পত্নী ছিলেন। সেই সময় পিতা প্রজাপতি দক্ষের মুখে স্বামী দেবাদিদেব শিবের অপমান শুনে যজ্ঞের আগুনে নিজেকে আত্মাহুতি দেন। সেই কারণে পরবর্তী জন্মে তাঁর দেহের রঙ ঘন কৃষ্ণবর্ণ ছিল। দেবী পার্বতীর এহেন গাত্রবর্ণ দেখে স্বামী ভোলানাথ তাঁকে আদর করে ‘কালিকে’ বলে ডাকতেন। একবার শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামে দুই ভয়ানক অসুরদ্বয় ব্রহ্মর বরে পরম শক্তির অধিকারী হলেন। তাঁরা এমন বর পেলেন যে কোনও অযোনি সম্ভুত নারী ছাড়া তাঁদের বধ সম্ভব নয়। ফলে তাঁরা কার্যত অমর হয়ে উঠলেন। এই বর পেয়েই শুম্ভ ও নিশুম্ভ স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল দখল করে ভয়ঙ্কর অত্যাচার শুরু করলেন ঋষি ও দেবতাদের ওপর। বিপাকে পড়ে ঋষি ও দেবতারা দেবাদিদেব মহাদেবের শরণাপন্ন হলেন। সব শুনে মহাদেব সকলের সামনেই পার্বতীকে বললেন, “কালিকে তুমিই এঁদের উদ্ধার করো”। সকলের সামনে মহাদেব তাঁর গাত্রবর্ণ নিয়ে রসিকতা করায় চরম ক্রুদ্ধ হলেন দেবী পার্বতী। তিনি মানস সরোবরের ধারে কঠিন তপস্যা করে শীতল মানস সরোবরে অবগহণ করলেন। এর পর দেবী পার্বতী তাঁর দেহের ঘোর কৃষ্ণবর্ণ কোষ বা কোশিকা ত্যাগ করে চাঁদের মতো গৌড়বর্ণ ধারণ করলেন। ওদিকে অন্তর্যামী শিব, দেবী পার্বতীর ত্যাগ করা কোশিকা থেকে ঘোর কৃষ্ণবর্ণা এক পরমা সুন্দরী নারীমূর্তি সৃষ্টি করলেন। দেবী খুশি হয়ে তাঁর নাম রাখলেন কৌশিকী। এর পর শিবের নির্দেশে দেবী কৌশিকী বধ করলেন শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামে সেই অসুরদ্বয়কে। দেবী কৌশিকীই পরবর্তী সময় কালী রূপে পূজিতা হন। আবার মতান্তরে তিনিই দেবী তারা। যেহেতু তিনি অযোনি সম্ভুত, অর্থাৎ মাতৃগর্ভে তাঁর জন্ম নয়, তাই তিনি শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করতে পেরেছিলেন। অনেকের মতে, এই কৌশিকী অমাবস্যা তিথিতেই জন্ম হয়েছিল দেবী কৌশিকীর। কিন্তু এই মত নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, এই কৌশিকী অমাবস্যা তিথিতেই তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন দেবী পার্বতী।
এই কৌশিকী অমাবস্যা তিথি সাধকদের কাছে মহা গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বাস, এই তিথিতে সামান্য সময়ের জন্য খুলে যায় স্বর্গ এবং পাতালের দ্বার। ফলে এই তিথিতে যে সাধক তপস্যা করেন, তাঁর সিদ্ধিলাভ খুব সহজে হয়। তিনি ধণাত্মক বা ঋণাত্মক যে সাধনাই করুন না কেন, তাঁর কাঙ্খিত সিদ্ধি তিনি পেয়ে যান এই এই তিথিতে। কৌশিকী অমাবস্যার রাতকে বলা হয় “তারা রাত্রি”। এই রাতেই সিদ্ধিলাভ করে স্বয়ং মা তারার দর্শন লাভ করেছিলেন বামাখ্যাপা। ফলে সাধকদের কাছে এই রাত বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বহু সাধক এই রাতে গভীর তপস্যায় মগ্ন থাকেন তারাপীঠ মহাশ্মশানে। কৌশিকী অমাবস্যা উপলক্ষ্যে সেজে ওঠে বীরভূমের অন্যতম শক্তিপীঠ তারাপীঠ। প্রচুর ভক্তের সমাগম হয়। মহাশ্মশানে অসংখ্য তান্ত্রিক সাধক সাধনা করেন। বৌদ্ধ তন্ত্র মতে এই দিন নীলসরস্বতীর সাধনা হয়। বৌদ্ধ তান্ত্রিকরাও এই রাতে বিশেষ সাধনা করেন সিদ্ধিলাভের জন্য। আবার এই নীলসরস্বতী হলেন হিন্দুদের কাছে মা তারা। যিনি প্রখর হলাহলের জ্বালা থেকে শিবকে মুক্তি দিয়েছিলেন নিজের স্তন্যপান করিয়ে। তিনিই শিবের তারণকারী মা তারা। এটাও একটা দিক। সবমিলিয়ে কৌশিকী অমাবস্যা তিথি তন্ত্রসাধকদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক তিথি।
Discussion about this post