আর জি কর হাসপাতালে নারকীয় হত্যাকাণ্ড। এক কর্তব্যরত মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের পরও নিরুত্তাপ ছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। নিয়মমাফিক পুলিশকে জানানোর বেশি তাঁদের তরফে আর সেরকম কিছু করার প্রমান মেলেনি। এমনকি হাসপাতালের পক্ষ থেকে নিহত চিকিৎসকের বাড়িতে বারবার ফোন করা হলেও ভুল তথ্য দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সবমিলিয়ে সিবিআইয়ের আতস কাঁচের নীচে রয়েছেন আর জি কর হাসপাতালের কয়েকজন আধিকারিক। তবে পালের গোদা সন্দীপ পাল ইতিমধ্যেই গ্রেফতার হয়েছেন। তিনি আর জি কর হাসপাতালের অধ্যক্ষ ছিলেন। অভিযোগ, তাঁর অনুমতি ছাড়া একটা পাতাও নড়তো না আর জি কর হাসপাতালে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দুর্নীতিতে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন তিনি, এমনটাই অভিযোগ আর জি করের জুনিয়র ডাক্তারদের। তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন আর জি করের প্রাক্তন রোগী কল্যান সমিতির সভাপতি তথা তৃণমূল বিধায়ক ডঃ সান্তনু সেন। কিন্তু আসল কথা হল, এই সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে এর আগেও বহুবার টালা থানায় লিখিত অভিযোগ জানানো হয়েছিল। এমনকি স্বাস্থ্যভবনেও দুর্নীতির প্রমান-সহ অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, কোনও বারই ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। টালা থানা আবার আগ বাড়িয়ে সন্দীপ ঘোষকে ক্লিনচিট দিয়েছিল।
আর জি কর হাসপাতালে দুর্নীতি নিয়ে এক পৃথক মামলায় সিবিআইকে তদন্তভার দেয় কলকাতা হাইকোর্ট। ফলে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের মামলার পাশাপাশি আর জি কর হাসপাতালের দুর্ণীতি নিয়েও তদন্ত করছে সিবিআই গোয়েন্দরা। যদিও সন্দীপ ঘোষ-সহ আর জি কর হাসপাতালের দুর্নীতির তদন্তে রাজ্য সরকার একটা স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম বা সিট গঠন করেছিল। কিন্তু অভিযোগ ওঠে, সিট গঠনের নামে রাজ্য সরকার সেই দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে চাইছে। এরপরই কলকাতা হাইকোর্ট তদন্তভার কেন্দ্রীয় এজেন্সির হাতে তুলে দেয়। তদন্তভার হাতে পেয়েই সিবিআই পরপর ১৬ দিন ধরে জেরা করে সন্দীপ ঘোষকে। তারপর গ্রেফতার করে। প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে সিবিআই গ্রেফতার করার খবর পাওয়ার পরই জুনিয়র চিকিৎসকরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। কিন্তু তাঁদের এও বক্তব্য, আরও অনেকে রয়েছেন এই দুর্নীতিচক্রে। এই চক্র না ভাঙা পর্যন্ত তাঁদের লড়াই চলবে। এদিকে সন্দীপ ঘোষকে ঘিরে গণক্ষোভ আছড়ে পড়ল আদালত চত্বরে। তাঁকে আদালত থেকে বের করার সময় চোর চোর ধ্বনি যেমন ওঠে, তেমনই তাঁকে কেউ একজন সপাটে চড়ও মারেন।
এবার আসা যাক আগের কথায়। আর জি কর হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ কতটা প্রভাবশালী, তার প্রমান রয়েছে বহু ঘটনায়। এর আগেও সন্দীপ ঘোষের দিকে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু কোনও বারই তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত হয়নি। আর জি কর হাসপাতালের আখতার আলি নামে এক ডেপুটি সুপার তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। তিনি সমস্ত তথ্যপ্রমান-সহ সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিলেন রাজ্যের ভিজিল্যান্স কমিশন এবং স্বাস্থ্য ভবনে। কিন্তু কোনও এক অদৃশ্য ইন্দ্রজালে তাঁর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করেনি স্বাস্থ্য ভবন। এখানেই শেষ নয়, সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে টালা থানাতেও একবার লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছিল। সেই তদন্তে নেমে টালা থানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক আদালতকে জানিয়েছিলেন সন্দীপ কোনও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নয়। এর পরেও টালা থানায় সন্দীপের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর চেষ্টা হয়। কিন্তু এবার আর অভিযোগই নেয়নি থানা। পরে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন ওই ব্যক্তি।
অভিযোগ, আর জি কর হাসপাতালকে নিজের সম্পত্তি বলেই ভাবতেন প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ। হাসপাতালের গেষ্ট হাউসে বসাতেন মদের আসর। তাঁর পক্ষের ছাত্রদের অবাধে মদ্যপানে ছাড়পত্র দেওয়া। অন্যান্য ছাত্রদের হুমকি ও ভয় দেখানো। হাসপাতালের ক্যান্টিন, খাবারের স্টল, সুলভ শৌতালয়গুলিকে টাকার বিনিময়ে বেআইনিভাবে অন্যের হাতে তুলে দেওয়া। হাসপাতালে বিভিন্ন কাজের টেন্ডারে দুর্নীতি, ল্যাব টেকনিশিয়ান-সহ চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগে দুর্নীতি। সবচেয়ে মারাত্মক অভিযোগ দুটি। প্রথমটি হল হাসপাতালের বায়োমেডিকেল বর্জ্য টাকার বিনিময়ে বেআইনিভাবে পাচার করা। জানা যায়, হাসপাতালের ব্যবহার করা সিরিঞ্জ, স্যালাইনের বোতল, রবার গ্লাভস বা অন্যান্য বায়োমেডিকেল বর্জ্য মিলিয়ে প্রায় ৫০০ কেজি বাইরে পাচার হতো প্রতিদিন। জানা যায় বাংলাদেশে পাচার হয়ে যেত এই দ্রব্যগুলি। দ্বিতীয়টি হল মর্গে দুর্নীতি। আর জি করের মর্গ থেকে লাস পাচার হয়ে যেত সন্দীপ ঘোষের অঙ্গুলিহেলনে। অভিযোগ, বেওয়ারিশ দেহ থেকে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটে তা বেসরকারি হাসপাতালে পাচার হয়ে যেত। লক্ষ লক্ষ টাকার লেনদেন ছিল। এবার সিবিআই সব দিক তদন্ত করে দেখছে। তাই এই দুর্নীতিতে আরও অনেকে গ্রেফতার হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে বলেই মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল।
Discussion about this post