উত্তাল বাংলাদেশ। সারা বিশ্ব উদ্বিগ্ন। একমাত্র আশার আলো দেখছিল কলকাতা বিমানবন্দরের রফতানিকারক সংস্থাগুলি। অনেকেই ভেবেছিলেন, এবার হয়তো বাংলাদেশি পণ্যের চাপ কমবে কলকাতা বিমানবন্দরে। কিন্তু না, তা হয়নি। সামান্য কিছু কমলেও প্রতিদিন প্রায় ২৫ থেকে ৩০ টন বাংলাদেশি পণ্য কলকাতা বিমানবন্দর থেকে মধ্যপ্রাচ্য অথবা পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের উদ্দেশ্যে উড়ে যায়। আর এতেই সমস্যায় পড়ছিলেন কলকাতা ও আশেপাশের রাজ্যের রফতানিকারক সংস্থাগুলো। তাঁদের অভিযোগ, কলকাতা থেকে প্রতিদিন যে ৩৫–৪০ টন পণ্য বিদেশে এক্সপোর্ট বা রফতানি হয়, তার মধ্যে বাংলাদেশি পণ্যই থাকছে ২৫–৩০ টন। যদিও বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের শোচনীয় অবস্থার জন্য বর্তমানে সামান্য কিছুটা ভার কমেছে। যদিও কলকাতায় কার্গো ফ্লাইট মাত্র দুই-একটা চলাচল করে। ফলে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে পশ্চিমা দেশগুলিতে যাত্রীবাহী উড়ানের পেটেই ঠেসে পাঠানো হয় রফতানি পণ্য। ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা থাকায় বাংলাদেশি রফতানিকারকরা বেশি মাত্রায় সেই পণ্য বুক করায় মার খাচ্ছিলেন ভারতের রফতানিকারকরা। ৮ এপ্রিল আচমকা বিজ্ঞপ্তি জারি করে ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডিরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস বিভাগ জানিয়ে দেয় ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় কোনও দেশে রফতানি পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করা হল। এই খবর আসার পরই ভারত ও বাংলাদেশ জুড়েই হইচই শুরু হয়ে যায়। আচমকা কেন বাংলাদেশকে এই সুবিধা দিতে অস্বীকার করল ভারত সেই প্রশ্নেই মাথায় হাত পড়ে বাংলাদেশের। বিতর্ক শুরু হতেই ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রনধীর জয়সওয়াল জানিয়ে দেন, বাংলাদেশের পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করার যে সিদ্ধান্ত ভারত নিয়েছে, তা নেপাল বা ভুটানগামী পণ্য চালানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
ভারত সরকারের এই বক্তব্য সামনে আসার পর কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন বাংলাদেশের তদারকি সরকার। যদিও ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের নিয়ম মেনে ভারত নেপাল ও ভূটানের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করতে পারে না। কারণ ভারতের এই দুই প্রতিবেশি দেশ পুরোপুরি স্থল দ্বারা পরিবেষ্টিত। নতুন নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, বর্তমানে ট্রানজিটে থাকা বাংলাদেশি পণ্য ভারত ছাড়তে পারবে, তবে নতুনভাবে কোনও পণ্যের চালান ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা আর পাবে না। ভারতের অ্যাপারেল এক্সপোর্টার্স কাউন্সিল এই সুবিধা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিল, কারণ বাংলাদেশ ও ভারত বর্তমানে তৈরি পোশাক বা রেডিমেড পোশাক খাতে প্রতিযোগিতা করছে। এখন প্রশ্ন হল, ভারত এই সুবিধা বাতিল করায় বাংলাদেশ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অথবা বাংলাদেশ আর কি কি বিকল্প পথ পাবে?
মূলত দুটি কারণে ভারতের বিমানবন্দর ও স্থলবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা তৈরি পোশাক বা অন্য কোনও পণ্য তৃতীয় দেশে পাঠিয়ে থাকেন। প্রথমত, কলকাতা থেকে পণ্য পাঠানোর খরচ বাংলাদেশের থেকে তুলনামূলক অনেক কম এবং সেখান থেকে পশ্চিমা দেশের প্রায় সবগুলো রুটে সরাসরি পণ্য পরিবহন সম্ভব। আর দ্বিতীয় কারণটি হল, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সময়মত ক্রেতা দেশের কাছে পণ্য পৌঁছাতে পারেন না বাংলাদেশের এক্সপোর্টাররা, তাই পেট্রাপোল স্থলবন্দর ব্যবহার করে দ্রুত কলকাতা বন্দরে পৌঁছনো যায়। আবার অনেক ধরণের পণ্য আছে যা পাঠানোর পরিকাঠামোই নেই চট্টগ্রাম বা মোংলা বন্দরে। ফলে সেই পণ্য সড়ক বা রেল পথে চলে আসতো কলকাতা বা হলদিয়া বন্দরে। সেখান থেকে বড় জাহাজে পাঠানো হতো ক্রেতা দেশে। ফলে মনে করা হচ্ছে ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করলেও বাংলাদেশের রেডিমেড পোশাক শিল্পের খুব একটা সমস্যা হবে না। কারণ, এই মুহূর্তে প্রায় ১৫০-র কাছাকাছি কারখানা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে বাংলাদেশে। কিন্তু সমস্যায় পড়বে অন্যান্য পণ্যের পরিবহন। বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বলছেন, ঢাকার চেয়ে কম খরচে কার্গো ভাড়া নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায় ভারতে। কলকাতা বিমানবন্দর দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে প্রতি কেজি পণ্য পাঠানোর খরচ দুই থেকে আড়াই ডলার। সেখানে বাংলাদেশে তা ৫-৬ ডলার। তাঁদের দাবি, ভারতের কার্গো ভাড়া কেমন হবে তা ঠিক করে ভারতের সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। এ কারণে কোনও পরিবহন উড়োজাহাজ চাইলেই ভাড়া বাড়াতে পারে না। অন্যদিকে বাংলাদেশে ভাড়া ঠিক করে বিভিন্ন এয়ারলাইন্স সংস্থাগুলো। ফলে একটু চাপ বেশি হলেই তাঁরা ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। তাঁদের আরও দাবি, এখন জাহাজে করে কলম্বো, মালদ্বীপ, দুবাই বা পাকিস্তানে পাঠাতে হবে। সেখান থেকে উড়োজাহাজে করে পণ্য যাবে বিদেশে। ভারত থেকে পাঠালে যে সময় ও খরচ বাঁচত, এখন তা হবে না।
Discussion about this post