গত ৪ এপ্রিল থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। যদিও মাত্র ৪০ মিনিটের ওই বৈঠককে ‘সৌজন্য সাক্ষাৎ’ বলাই শ্রেয় বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু এই বৈঠকের পর যখন বাংলাদেশ দাবি করছিল এবার সম্পর্কের শীতলতা কমবে, ভারত শেখ হাসিনাকে ফেরত দিতে রাজি হয়েছে, ঠিক তার পরই দেখা গেল ভারতের হিট ব্যাক। ৮ এপ্রিল রাতে ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায় যে ভারত সরকার বাংলাদেশকে ২০২০ সালের জুন মাসে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করল। এবার থেকে শুধুমাত্র নেপাল ও ভূটান ছাড়া বাংলাদেশ ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে তৃতীয় কোনও দেশে বাণিজ্য করতে পারবে না।
এতে যে জোরদার ধাক্কা খাবে বাংলাদেশের বাণিজ্য এ কথা স্বীকার করে নিচ্ছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু আচমকা কেন ভারত সরকার এমন একটা সিদ্ধান্ত নিল? এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছিল কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক মহলে। পরে যা জানা যাচ্ছে তা হল, এই সিদ্ধান্ত আসে গত ৬ এপ্রিল রাতে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের একটি বৈঠকের পরই। বিশেষ সূত্রের খবর, বিমসটেকের সম্মেলনের ফাঁকে নরেন্দ্র মোদি এবং মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে যে পার্শ্ববৈঠক হয় সেটা নিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করতে যান অজিত ডোভাল। তাঁদের মধ্যে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে নানান আলোচনা হয়। কিন্তু হাসিনা চান না যে ভারত বলপ্রয়োগ বা সেনা অভিযান করুক বাংলাদেশে। তিনি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে পরিস্কার জানিয়ে দেন, তিনি রক্তপাত একেবারেই চান না।
যদি চাইতেন তাহলে তিনি গত বছরের ৪ অথবা ৫ আগস্টই তা করতে পারতেন। এভাবে দেশ থেকে তাঁকে পালিয়ে আসতে হতো না। এরপরই তিনি মুহাম্মদ ইউনূসকে চাপে ফেলতে ভারতকে কয়েকটি প্রস্তাব দেন। যার মধ্যে ছিল ২০২০ সালে তাঁরই আমলে ভারতের সঙ্গে করা এই ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি বাতিলের প্রস্তাব। এছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে থাকা আরও দুটি চুক্তি বাতিলের প্রস্তাব তিনি দিয়েছেন ভারতকে। যা ভারত সরকার আগামীদিনে কার্যকর করতে পারে বলেই জানা যাচ্ছে। এও জানা যাচ্ছে, ওই বিশেষ চুক্তিগুলি হয়েছিল ২০১৮ ও ২০২১ সালে। এই তিনটি চুক্তি যদি ভারত বাতিল করে তাহলে মুহাম্মদ ইউনূস প্রবল চাপে পড়বেন।
অন্যদিকে আরও একটি বিষয় নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন। সেটা হল বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের ডবল গেম। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান বর্তমানে রুশ সফরে আছেন। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতিতেই বাংলাদেশ সেনার পাঁচ উচ্চপদস্থ কর্তাকে গৃহবন্দি করা হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। গত বছরের জুলাই মাসে ছাত্র বিদ্রোহের সময় এই পাঁচ সেনা কর্তার ‘নেতিবাচক’ ভূমিকা ছিল বলে বিভিন্ন রিপোর্টে দাবি করা হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে এই নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়নি। তবে সর্বভারতীয় বেশ কয়েকটি মিডিয়া এই দাবি করছে। ভারতীয় গোয়েন্দা সূত্র অনুযায়ী, এই পাঁচ সেনাকর্তা আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ট বলে পরিচিত এবং গত বছরের পাঁচ আগস্ট শেখ হাসিনাকে ভারতে পালাতে সাহায্য করেছিলেন। নবভারত টাইমসের রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, গৃহবন্দি থাকা এই পাঁচজন হলেন – ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম জাকারিয়া হুসেন, তিনি ইঞ্জিনিয়ারস ব্রিগেডের দায়িত্বে, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরান হামিদ, তিনি ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের দায়িত্বে।
জেনারেল হামিদ, যিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এডিসি ছিলেন। এছাড়া র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাবের কর্নেল আবদুল্লাহ আল-মোমেন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি-র লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহম্মদ রিদওয়ানুল ইসলাম এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর মহম্মদ নোমান আল ফারুক। এমন মনে করা হচ্ছে, শেখ হাসিনার সঙ্গে যে পাঁচজন সেনাকর্তা ওই বিশেষ বিমানে ভারতে এসেছিলেন, এরা তাঁরাই। ফলে এতদিন পর কেন তাঁদের গৃহবন্দি করা হল সেটা নিয়েই তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। একটি অংশের দাবি, জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান পুরো বিষয়টি জানেন। এবং তিনি পরিস্থিতির দিকে নজর ঘোরাতেই রাশিয়া সফর করছেন। তিনি শনিবার দেশে ফিরলেই এই পাঁচজনকে গ্রেফতার করে তাঁদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হবে বলে জানা যাচ্ছে। এটা যদি সত্যি হয় তাহলে কার্যত ডবল গেম খেলছেন সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান। যা ভারতের কাছে অত্যন্ত বিপজ্জনক। ফলে আগামীদিনে কি হয় সেটা দেখার জন্যই অপেক্ষা করছেন ওয়াকিবহাল মহল।
Discussion about this post