বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়ে গেল সম্প্রতি। এই বৈঠক ডাকা হয়েছিল লন্ডনে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের পর। অর্থাৎ, ওই বৈঠকে কি কি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, এর ফলাফল কি এবং ফেব্রুয়ারী মাসে ভোট ধরে নিয়ে কি কি প্রস্তুতি নেওয়া হবে সেটা নিয়েই আলোচনা হয়েছে। ব্যাপার স্যাপার দেখে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা অনেকটা গাছে কাঁঠাল দেখে গোঁফে তেল দেওয়ার মতো।
বিএনপি তাঁদের দীর্ঘ রাজনৈতিক জমানায় কখনোই লড়াই করে ক্ষমতা দখল করেছে এমন নজির ইতিহাসে খুব কম। বিএনপির শুরু থেকেই তাঁরা পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনার মতো ক্ষমতা হাতে পেয়েছে। ফলে তাঁরা সুযোগ সন্ধানী রাজনৈতিক দল হয়ে উঠেছে কালক্রমে। এবারও ঠিক তেমনটা হতে চলেছে বলেই মনে করছেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহল। কিন্তু, আদৌ কি বিএনপির সামনে গোলাপের পাঁপড়ি ছড়ানো আছে? নাকি গোলাপের কাঁটা কিছু রয়ে গেল? এই ব্যাপারে বিএনপি ভাবতে নারাজ। তাঁরা এখন কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, কে কোন মন্ত্রীত্ব পাবেন সেটা ঠিক করতে ব্যাস্ত!
গত সোমবার রাত সাড়ে আটটায় গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক বসেছিল। তাতে কার্যত সর্বসম্মতভাবেই সিদ্ধান্ত হয়েছে এখন থেকে অন্তরবর্তীকালীন সরকার, প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সমালোচনা করা যাবে না। লন্ডনের বৈঠকটি পজিটিভ হিসেবে তুলে ধরতে হবে এবং প্রচার করতে হবে। এবং এখন থেকেই ভোটের প্রস্তুতি শুরু করতে হবে। বিএনপির নেতারা মনে করছেন, ভোট হলে তাঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে এবং সরকার গঠন করবে। এটা ধরে নিয়েই ইউনূসের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁরা, যাতে ফেব্রুয়ারীতে ভোট হয়। কিন্তু আদৌ কি ফেব্রুয়ারীতে ভোট হবে? এটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।
ক্ষমতায় আসার পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যত বার জামাতের আমীর অথবা জাতীয় নাগরিক পার্টি বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতাদের ফোন করেছেন, ডেকে কথা বলেছেন, আলোচনা করেছেন। কিন্তু একবারও কি বিএনপির নেতাদের কাছে ইউনূসের ফোন গিয়েছে? বা তাঁদের প্রথমে ডেকে কোনও বিষয়ে আলোচনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা? এটা হয়নি। তাহলে লন্ডনে এমন কি হল, যে তারেকের সঙ্গে বৈঠক করে ভোট এগিয়ে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে দিলেন মুহাম্মদ ইউনূস? ঘোট একটা কিছু পেকেছে এটা বলাই বাহুল্য। ফেব্রুয়ারীতে ভোট হবে বলার পর ঢাকায় ঐক্যমত কমিশনের একটি বৈঠক বয়কট করে জামায়তে ইসলামী।
জানা যায়, পরদিনই প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস সরাসরি ফোন করেন জামাতের আমীর ডঃ সফিকুর রহমানকে। অর্থাৎ, তাঁকে বোঝাতে পেরেছেন তাঁর বাধ্যবাধকতা। অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, লন্ডনের বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে ফেব্রুয়ারি মাসেই ভোট হবে এটা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন সংস্কার ও বিচার প্রক্রিয়া যদি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়, তবে রমজানের আগে ভোট হতে পারে বলে বলা হয়েছে। অর্থাৎ এখানে অনেকগুলি যদি ও কিন্তু রয়েছে। কিন্তু বিএনপি মুহাম্মদ ইউনূস ও খলিলুর রহমানের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে দিয়েছে। ভোট হলে তারাই ক্ষমতা পাবে ধরে নিয়ে বিএনপি নেতারা এখন থেকেই আত্মহারা। যদিও পাঁচই আগস্টের পর থেকে বিএনপি নেতৃত্ব এই আশাই করে আসছিল। কিন্তু আসল প্রশ্ন হল, এই যে এতগুলি কমিশনের শত শত সংস্কার প্রস্তাব, শতাধিক মামলার বিচার প্রক্রিয়া কি এত কম সময়ে সম্পন্ন করা যাবে? সব রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ঐক্যমত কমিশন কি একমত হতে পারবে? নির্বাচনের বিষয়টি এখনও অথৈ জলে রয়েছে।
জানা যাচ্ছে বিজেপির জাতীয় কর্ম সমিতির বৈঠকে একমাত্র সালাউদ্দিন আহমেদ বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করেছেন। বয়সে নবীন এই বিএনপি নেতা এই সমস্ত যুক্তি দিয়েই বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন ফেব্রুয়ারিতে ভোট আদৌ সম্ভব নয়। তাই সংস্কার পরে হবে ডিসেম্বরেই ভোট চাই বলে বিএনপি’র পূর্ববর্তী অবস্থান নিয়েই আন্দোলন চালানো উচিত। কিন্তু তার কথা স্থায়ী কমিটির কোন সদস্যই কানে তোলেননি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে ইউনুসের বৈঠকে আসলে অন্য কোনও আঁতাত হয়েছে। কিন্তু গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জর্জরিত বিএনপিকে লন্ডনের বৈঠক এবং ক্ষমতার লোভ একই আসনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাদের এই কল্পনার ফানুস অচিরেই ফুটো হয়ে যাবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ।
Discussion about this post