বাংলাদেশ, ভারতের এই প্রতিবেশী দেশের যে কোনও গণতান্ত্রিক সরকারের স্থায়িত্ব বরাবরই ভঙ্গুর। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের হাত থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া বাংলাদেশ কখনও সেনা শাসনে গিয়েছে, কখনও আবার অন্তরবর্তীকালীন সরকারের শাসনে গিয়েছে। আবার গণতান্ত্রিকভাবে জয়ী রাজনৈতিক দল বা জোট সরকারও বেশ কয়েকবার শাসন করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু কখনও সামরিক অভ্যুত্থান, কখনও গণ অভ্যুত্থান বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারকে। যেমন ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ভোটে নির্বাচিত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে এক গণ অভ্যুত্থান। মূলত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেই গণ অভ্যুত্থান চরম রূপ নিয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন, এবং মাত্র ৭২ ঘন্টার ব্যবধানে একটা তদারকি সরকার গঠিত হয়। ঠিক যেন সিনেমার চিত্রনাট্য। এত বড় ধরণের অভ্যুত্থানের পর এত দ্রুত সমাধান খুব কম দেশেই হয়েছে, বা এই প্রথম দেখা গেল বলা যায়। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন অর্থনীতিবিদ তথা শান্তিতে নোবেলজয়ী ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস বাংলাদেশের নতুন তদারকি সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। মূলত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব এবং মুহাম্মদ ইউনুসের ইচ্ছা অনুযায়ী একটা উপদেষ্টামন্ডলী নিযুক্ত হয়। তারপর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি বইছে উল্টো দিকে। যে তদারকি সরকারের প্রধান দায়িত্ব ছিল ফ্রি এন্ড ফেয়ার ইলেকশন বা সুষ্ঠ ও অবাধ নির্বাচন করিয়ে একটা স্থায়ী সরকারের হাতে দেশের শাসনভার তুলে দেওয়ার। সেই তদারকি সরকারই এখন ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নির্বাচনকে দূরে ঠেলে দিতে চাইছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দলের দুই শীর্ষ নেত্রী অনুপস্থিত। যা মুহাম্মদ ইউনুসের কাছে একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছে আরও কয়েকমাস ক্ষমতার শীর্ষে থাকার।
হ্যাঁ, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সেই অর্থে কোনও শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নেই। প্রথমে আসা যাক আওয়ামী লীগের কথায়। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল, যার নেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং এই মুহূর্তে প্রাণ বাঁচিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। শেখ হাসিনা ছাড়াও আওয়ামী লীগের বাকি শীর্ষ নেতা প্রাণ ভয়ে বিদেশে পালিয়েছেন অথবা গ্রেফতার হয়ে বিচারাধীন। ফলে বর্তমানে আওয়ামী লীগ পুরোপুরি নেতৃত্ববিহীন। অপরদিকে রয়েছে বিএনপি। এই দলের সর্বোচ্চ নেত্র বেগম খালেদা জিয়া, যিনি দীর্ঘদিন কারাবন্দী ছিলেন শেখ হাসিনার আমলে, এমনকি তিনি গুরুতর অসুস্থ রয়েছেন। গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে পালাবদলের পরদিনই খালেদা জিয়া কারামুক্ত হন, এবং তাঁর বিরুদ্ধে থাকা যাবতীয় অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়। ফলে এই মুহূর্তে খালেদা জিয়া পুরোপুরি মুক্ত, কিন্তু তাঁর অসুস্থতা কমেনি। ফলে আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি লন্ডনে গিয়েছেন। তাঁর ছেলে তারেক রহমানও লন্ডনে বসবাস করেন দীর্ঘদিন ধরে। ফলে বিএনপি-র দুই শীর্ষ নেতা এই মুহূর্তে বাংলাদেশে অনুপস্থিত। আর যারা আছেন, তাঁরা এককভাবে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী নন। ফলে বলাই যায়, বাংলাদেশের রাজনীতির ময়দান এই মুহূর্তে ফাঁকা। আর সেই ফাঁকা ময়দানে গোল দেওয়ার জন্য মুহাম্মদ ইউনুস একাই বাদশাহ।
বিএনপি প্রথম থেকেই চাইছে বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচন হোক। কারণ গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব কার্যত নেই। নেতা কর্মীদের সিংহভাগ গা ঢাকা দিয়েছেন, অথবা জেলবন্দি। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে সবচেয়ে বেশি ফায়দা তুলবে বিএনপি। অসুস্থ খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানকে শূন্যস্থান পূরণের জন্য চাইছে বিএনপি নেতা-কর্মীরা। কিন্তু তারেক রহমান লন্ডন থেকে কবে বাংলাদেশে ফিরবেন সেটা কেউ জানেন না। অপরদিকে ইউনুসের তদারকি সরকার ও ছাত্র নেতা এবং জামাত শিবিরের সঙ্গে বিএনপি-র যেভাবে সংঘাত হচ্ছে, তাতে তারেক রহমান চিন্তিত। দেশে ফিরলে তিনিও বিপদে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন বিএনপি-র একটা বড় অংশ। ফলে একদিকে আওয়ামী লীগ এবং অন্যদিকে বিএনপি, বাংলাদেশের দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দলই এখন নেতৃত্বহীনতায় ভুগছে। ফলে পথের কাঁটা উপড়ে মুহাম্মদ ইউনুস ও জামাত শিবির এখন বাংলাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে গিয়েছে। তাই নির্বাচন বিশ বাও জলে।
Discussion about this post