আজকের অশান্ত বাংলাদেশ একদিনে কোনও এক হাদির মৃত্যুর জন্য হয়নি। বাংলাদেশ অশান্ত করা হচ্ছে গভীর এক পরিকল্পনার মাধ্যমে। বাংলাদেশকে ঘিরে সাম্প্রতিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক অনিশ্চিয়তা, ইসলামী মৌলবাদী শক্তির উত্থান এবং ভারত-বিরোধী এই মনোভাব সুচারুরূপে সৃষ্টি করা হয়েছে। কোনওটাই আলাদা আলাদা ঘটনা নয়, সবগুলো এক সুতোয় বাঁধা। এর সঙ্গে জড়িত বিশ্বের কয়েকটি বৃহৎ পরাশক্তি, আঞ্চলিক মধ্যস্থতাকারী শক্তি এবং স্থানীয় আদর্শগত কিছু গোষ্ঠী। প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বার্থে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমেছে। ফলস্বরূপ বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ এখন ঠিক কার হাতে, সেটাই স্পষ্ট নয়। এটা বলাই যায়, এই মুহূর্তে মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রক নন। লাগাম অন্য করোও হাতে রয়েছে।
এর শুরুটা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিগত এক দশকে দক্ষিণ এশিয়ায় ওয়াশিংটনের বৈদেশিক নীতির মূল লক্ষ্য ছিল চিনকে যে কোনও মূল্যে প্রতিহত করা। সেই অনুযায়ী ভারতের সঙ্গে কৌশলগত বন্ধুত্ব রেখে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চিনের চারপাশে একটা চাপের বলয় তৈরি করার চেষ্টা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই বলয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত অংশ হল মিয়ানমার। যেখনে চিনের প্রত্যক্ষ প্রভাব ওয়াশিংটনের কাছে মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দীর্ঘকাল ধরে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ, জাতিগত বিদ্রোহ ও রাষ্ট্রহীনতা সৃষ্টি করে চিন সেখানে ছড়ি ঘোরাতে শুরু করেছিল। কিন্তু সরাসরি মিয়ানমারে প্রবেশ করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এর জন্যই ওয়াশিংটনের কাছে একটি বিকল্প প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজন ছিল। ঠিক এখানেই বাংলাদেশের ভূমিকাটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। এর ভৌগোলিক অবস্থান, বঙ্গোপসাগরে প্রবেশাধিকার, উত্তর-পূর্ব ভারতের সংলগ্নতা এবং মায়ানমারের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে বাংলাদেশ একটি সম্ভাব্য লজিস্টিক ও রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে চিহ্নিত হয় ওয়াশিংটনের নিয়ন্ত্রকদের কাছে। চিন ও মিয়ানমারের জন্য বাংলাদেশ হয়ে ওঠে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ’।
সরাসরি ভারতকে এড়িয়ে বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করাটা ওয়াশিংটনের জন্য সমস্যা ছিল। ফলে তাঁরা সঙ্গে নিল পাকিস্তানকে। কারণ, বাংলাদেশের ইসলামিক শক্তিকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সমস্যার ছিল। তাই পাকিস্তান। ওয়াশিংটন জানে, বহু দশক ধরে ইসলামিক জঙ্গি নেটওয়ার্ক, মাদ্রাসা ব্যবস্থা এবং অঘোষিত সশস্ত্র গোষ্ঠী পরিচালনায় অভিজ্ঞ ইসলামাবাদ। এর প্রমান তাঁরা আফগানিস্তান থেকে কাশ্মির সব জায়গায় রেখেছে। আবার বাংলাদেশ নিয়ে পাকিস্তানের চিন্তাভাবনা আলাদা ছিল। তাঁরা চাইছিল ১৯৭১ সালের বদলা নিতে এবং ভারতের বিরুদ্ধে একটা নতুন ফ্রন্ট খুলতে। ফলে পাক আইএসআই ওয়াশিংটনের টাকায় এবং পরামর্শে বাংলাদেশে ধীরে ধীরে ইসলামিক কট্টরপন্থাকে জল ও সার দিয়ে বড় করতে শুরু করে। যা এখন মহিরূহে পরিণত হয়েছে। যদিও বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের চাওয়া পাওয়ার হিসেব আলাদা। তবুও তাঁরা সমান্তরালভাবে এখানে অপারেট করছে। যদিও এই প্রক্রিয়ায় পাকিস্তান জানে যে যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত তাঁদের পুরোপুরি বিশ্বাস করবে না এবং প্রয়োজনে পাশ কাটিয়ে যাবে। সেই কারণে বাংলাদেশে ইসলামিক জিহাদ এবং কট্টর ভারত-বিরোধিতার উন্মেষ ঘটিয়েছে পাকিস্তানের আইএসআই। এখন কার্যত তাঁরাই নিয়ন্ত্রণ করছে মুহাম্মদ ইউনূসের প্রশাসনকে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক সম্পর্ক কার্যত বিষিয়ে উঠেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রয়োজন সূক্ষ্ম কূটনীতি, শক্ত বার্তা দেওয়ার ক্ষমতা এবং প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানসিতকা। অর্থাৎ, কেবলমাত্র নৈতিক অবস্থান যথেষ্ট নয়, ক্ষমতা প্রদর্শনের সম্ভাবনাটিও দৃশ্যমান রাখতে হবে। এবার আসা যাক দ্য গ্রেট গেম প্রসঙ্গে। বাংলাদেশকে ঘিরে একটি ‘নতুন গ্রেট গেম’-এর আভাস মিলছে। বাংলাদেশের পরস্পর কয়েকটি ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে সেখানে বিশ্বের কয়েকটি বৃহৎ শক্তির গুপ্তচর বাহিনীর খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে। এখানে যেমন মার্কিন সিআইএ এবং পাক আইএসআই সক্রিয়। তেমনই সক্রিয় ভারত, রাশিয়া, চিন, তুরস্ক, ইসরাইয়েলের গুপ্তচররাও। তাঁদের মধ্যে অদৃশ্য লড়াইয়ে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২৫-৩০ জন এজেন্ট। তবে আশ্চর্যজনকভাবে সবই পাকিস্তান, তুরস্ক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। ফলে এই গ্রেট গেমের প্রথম ধাপে এগিয়ে ভারত, রাশিয়া, চিন। মনে করা যাচ্ছে, এখানে মার্কিন য়ুক্তরাষ্ট্রকে ঠেকাতে এবার একযোগে মাঠে নেমেছে এই তিন দেশ। সোমবার ঢাকায় সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত আলেকজ়ান্ডার গ্রিগোরাইভিচ। তিনি বলেন, সাধারণ নির্বাচনের আগে অশান্ত বাংলাদেশে শান্তি ফিরুক! এমনটাই চায় রাশিয়া। পাশাপাশি ভ্লাদিমির পুতিনের দেশ চায়, নয়াদিল্লির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যত দ্রুত সম্ভব স্বাভাবিক করুক বাংলাদেশ। অর্থাৎ, রাশিয়া সরাসরি ভারতের পাশে দাঁড়িয়ে গেল, যেমনটা সেই একাত্তরে ছিল। তাহলে বুঝছেন, এবার মুখোমুখি হচ্ছে দুটি অক্ষ।












Discussion about this post