আবারও উত্তাল বাংলাদেশ। চিত্রনাট্য কার্যত এক তবে এবার প্রেক্ষাপট আলাদা। গত বছর জুলাই-আগস্টের গণবিপ্লব যেভাবে রচিত হয়েছিল, যেভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল ঠিক সেভাবেই এগোচ্ছে বাংলাদেশ। সেবার শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতাকে উস্কে দেওয়া হয়েছিল প্রথমে। তারপর পিছন থেকে তাঁদের আন্দোলন হাইজ্যাক করে জামাত ও অন্যান্য ইসলামিক সংগঠনগুলি। এবারও ঠিক তাই হচ্ছে। জুলাই ঐক্য নামে এক আচমকা গজিয়ে ওঠা সংগঠন রাস্তায় নেমেছে ইনকিলাব মঞ্চের প্রধান ওসমান হাদির মৃত্যুর প্রতিবাদে। সেখানে ভিড় জমিয়েছে জামাত নিয়ন্ত্রিত অসংখ্য ইসলামিক সংগঠন। ফলে বৃহস্পতিবার রাতে সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে হাদির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হতেই বাংলাদেশে শুরু হয়ে যায় তান্ডব। এর প্রেক্ষাপট তৈরিই হয়ে ছিল ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে। আওয়াজ ছিল ভারত বিরোধিতার, আওয়াজ ছিল আওয়ামী লীগ বিরোধিতার। কোনও তদন্ত বা তথ্য প্রমানের ধার না ধরেই একদল মানুষ উঠেপড়ে লাগে হাদির ওপর গুলি চালানোর ঘটনায় ভারতকে সরাসরি দায়ী করতে শুরু করে দেয় তাঁরা। কেউ কেউ আওয়ামী লীগ ও ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র-কে দায়ী করে রাস্তায় নেমে পড়ে। ফলে দ্রুত বদলে যায় পরিস্থিতি। আর হাদির মৃত্যুর খবর সামনে আসতেই পরিস্থিতি চলে গেল নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যেন প্লট সাজানোই ছিল, শুধু সবুজ পতাকা দেখানোর অপেক্ষায় ছিল সকলে।
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, ঠিক এই কারণেই ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠল বাংলাদেশ। খানিকটা হিসেব কষেই চলল ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। বাংলাদেশের দুই সংবাদপত্র ‘প্রথম আলো’ এবং ‘দ্য ডেলি স্টার’-এর দফতরে ভাঙচুরের পরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল প্রথমেই। এরপর আক্রমণ হয় সেই ৩২ নম্বর ধানমন্ডির ঐতিহাসিক বাড়িটি। যা গত বছর ৫ আগষ্টের পর একাধিকবার আঁক্রান্ত হয়েছে। এদিন রাতেই আক্রান্ত হয় ছায়ানট নামে এক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। আরও জানা গিয়েছে, খুলনায় এক সাংবাদিককে গুলি করে হত্যা করেছে উত্তেজিত জনতা। ময়মনসিংহে এক যুবককে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে। এমনকি একজনকে গাছে বেঁধে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। রাজশাহীতেও মুজিবের অপর একটি বাড়ি এবং আওয়ামী লীগের দফতর ভাঙচুর করা হয়েছে। বাংলাদেশের বহু জায়গাতেই বিক্ষোভকারীদের মুখে ছিল শেখ হাসিনা এবং ভারত-বিরোধী স্লোগান।
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে বৃহস্পতিবার গভীর রাতেই জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি দেশবাসীকে ‘ধৈর্য ও সংযম’ বজায় রাখার আবেদন জানান।
কিন্তু তার কথা কেউ শোনেননি, রাতভর চলল তান্ডব। সূত্রের খবর, চট্টগ্রামে ভারতের উপদূতাবাস লক্ষ্য করে ঢিল-পাটকেল ছোড়ার অভিযোগ উঠেছে। রাত থেকে উপদূতাবাসের সামনে অবস্থানে বসেছেন ছাত্র-যুবদের একাংশ। তাঁদের মুখে ভারত বিরোধী স্লোগান। হাদির মৃত্যুর পর কেন এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হল? শরীফ ওসমান হাদি কি এতটাই জনপ্রিয় নেতা ছিলেন? নাকি তাঁর ভারত বিরোধী অবস্থানের জন্যই তাঁকে নিয়ে এই আবেগ? বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ভারত বিরোধী হাওয়া একমাত্র হাতিয়ার।
শুক্রবার ঢাকায় উচ্চপর্যায়ের বৈঠক ডেকেছেন মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু তাতেও কি পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে? বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ দাবি করছেন, এটা হওয়ারই ছিল। আর তা জানতো অন্তরবর্তী সরকার। তবুও সরকার কোনও আগাম প্রস্তুতি রাখেনি। বৃহস্পতিবার রাতে হাদির মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই ঢাকার শহবাগ চত্বরে জমায়েত শুরু হয়। এরপর একটি মিছিল বাংলামোটরে এনসিপি দফতর হয়ে প্রথম আলোর কার্যালয় পর্যন্ত যায়। একটা বিক্ষোভ মিছিল হয় সেখানে। এরপরও কোনও নিরপত্তা ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। গভীর রাতে ফের জমায়েত হয় এবং প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের দফতর ভাঙচুর করে আগুন ধরায় উত্তেজিত জনতা। তখনও আসেনি পুলিশ, সেনাবাহিনীর কোনও দল। অভিযোগ আগুন ধরিয়ে দেওয়ার বহু পরে আসে সেনাবাহিনী। এরপরে তাঁরা আটকে থাকা সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের উদ্ধার করে। এর থেকেই প্রমাণ হয় ইউনুসের সরকার কতটা তৎপর ছিল।












Discussion about this post