জ্বলছে বাংলাদেশ। শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার রাত থেকে। সিঙ্গাপুর থেকে যখন খবর এলো ভারত-বিদ্বেষী, আওয়ামী বিরোধী নেতার মৃত্যু হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় নেমে পড়ে বিপ্লবীরা। বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির দৈনিক ‘প্রথম আলো’র দফতরে ঢুকে তাঁরা নির্বিবাদে তাণ্ডব চালায়। তাণ্ডব হয়েছে ইংরেজি দৈনিক ‘ডেলি স্টার’-এর প্রধান দফতরে। সেখানে উন্মত্ত জনতা আগুন লাগিয়ে দেয়। কিছু ক্ষণেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে বহুতলে। ভিতরে আটকে পড়েন অন্তত ৩০ জন সাংবাদিক। প্রাণ বাঁচাতে সকলে বহুতলের ছাদে গিয়ে আশ্রয় নেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছোয় দমকল। আগুন নেভানোর পর ক্রেন এনে আটকে পড়া সাংবাদিকদের নামান হয়। ধানমন্ডিতে সঙ্গীতশিল্পী সন্জীদা খাতুন প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ‘ছায়ানট’-এর সাততলা ভবনের প্রতিটি কক্ষে ঢুকে ভাঙচুর চালানো হয়। রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের পার্টি অফিস ভাঙতে নামানো হয় বুলডোজ়ার।
জুলাই আন্দোলনের (২০২৪ সালের অগস্ট মাসে যার জেরে হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন) অন্যতম নেতা হাদি গত ১২ ডিসেম্বর দুপুরে ঢাকার পুরনো পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে গুলিবিদ্ধ হন। ইউনূস সরকারের অভিযোগ, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল এবং আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগের এক কর্মী হাদির মাথায় গুলি করেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারি উদ্যোগে হাদিকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি। বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর মৃত্যু হয়। ইনকিলাব মঞ্চ নামক সংগঠনের আহ্বায়ক হাদির মৃত্যুর পরেই বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ শুরু হয়।
প্রশ্ন হল কে এই হাদি? প্রথমত তাঁর পরিচয় সে একজন ভারত-বিদ্বেষী নেতা। হাদির পরিবারের সকলেই আলেম। তাঁর বাবা মৌলানা আব্দুল হাদি ছিলেন মাদ্রাসার শিক্ষক। ইসলামি শিক্ষাই তাঁদের জীবনের আদর্শ। হাদির জন্ম ঝালোকাঠির নলসিটি উপজেলায় খাসমহলে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। হাদি সবার ছোট। তাঁর হাতেখড়ি ঝালোকাঠির কাবিল মাদ্রাসায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক। মাদ্রাসা থেকে সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই, তাঁকে কম কটুকথা শুনতে হয়নি। হাদির চেহারা দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা জোরের সঙ্গে বিশ্বাস করতেন, এই ছেলেটা কোনও না কোনও দলের সদস্য। কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাঁর সরাসরি ছিল না। তাই, কারও কাছে সে আওয়ামী-বিরোধী, কারও কাছে সে বিএনপি-বিরোধী। জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার তাগিদে তিনি একসময় প্রাইভেট পড়াতেন। বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করেন। স্ত্রী যখন অন্তঃসত্ত্বা তখন হাদি গণঅভ্যুত্থানে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
শরিফ ওসমান হাদি ছিলেন বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে উঠে আসা এক ব্যতিক্রমী ছাত্রনেতা। বয়সে তরুণ হলেও ২০২৪ সালের ছাত্র অভ্যুত্থানের সময় তিনি হয়ে উঠেছিলেন আন্দোলনের অন্যতম পরিচিত মুখ। ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও মুখপাত্র হিসেবে রাজপথে, মিছিলে এবং সামাজিক মাধ্যমে তাঁর কণ্ঠ ছিল স্পষ্ট, ধারালো ও আপসহীন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তাঁর আশপাশের ছাত্র রাজনীতির পরিসরেই ওসমান হাদির উত্থান। প্রথম দিকে তিনি পরিচিত ছিলেন ছাত্র অধিকার, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ এবং রাষ্ট্রীয় দমননীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার এক সংগঠক হিসেবে। ধীরে ধীরে তাঁর নেতৃত্বগুণ ও সংগঠনের ক্ষমতা তাঁকে ছাত্র রাজনীতির গণ্ডি ছাড়িয়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিসরে নিয়ে আসে।
ভারতের প্রতি তাঁর ঘৃণা কতটা, সেটা তাঁর সাম্প্রতিক একটি বক্তব্য থেকে স্পষ্ট। গুলি খাওয়ার এক ঘণ্টা আগে সে তাঁর ফেসবুক পেজে ভারতের একটি বিকৃত মানচিত্র প্রকাশ করে। সেই ফেসবুক পেজে হাদি লেখেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসের বইগুলোত ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের উল্লেখ নেই। এই ইতিহাস আমাদের নিজেদেরকেই জানতে হবে। শিক্ষার্থীদের ‘হাসিনার তৈরি ন্যারেটিভে থেকে পলাশীর যুদ্ধি, সিপাহী বিদ্রোহ, ১৯৪৭, ১৯৭১ এবং ২০২৪ সালের ইতিহাস পড়তে হবে। ’
হাদিক আরও লেখে ‘বর্তমান সরকার যেন পেছনের কোনো শক্তি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। আসামিরা জামিনে মুক্তি পেয়ে ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে আর বিচার প্রত্যাশীরা ন্যায় বিচারের জন্য হাহাকার করছে।’ কথা বলেছেন, গণমাধ্যম নিয়েও। হাদির কথায় ‘গণমাধ্যমগুলো একপেশে আচরণ করছে। তারা টক-শোতে কেবল তাদেরকেই ডাকে, যারা একটি নির্দিষ্ট ন্যারেটিভ তৈরি করে। বিগত নির্বাচনগুলোতে ৫০ জনেরও বেশি বিনা ভোটের মুক্তিযোদ্ধা এমপি ছিলেন, কিন্তু তখন তাদের চেতনা কোথায় ছিল, সেই বিষয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না। ’
কেমন তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠ। কিছুদিন আগে একটা সভামঞ্চ থেকে তাঁকে বলতে শোনা যায় – ‘জুলাইয়ের সঙ্গে যদি গদ্দারি করেন, তাহলে আমার বাপেও আমার বাপ না। আমার মা আমার মা না। আমার সন্তান আমার সন্তান না’
প্রশ্ন উঠছে হাদির স্ত্রী সাহিদা পারভিন সামিয়া কোথায়? তাঁকে কেন দেখা যাচ্ছে না। বলা হচ্ছে পারভি সামিয়া একজন পর্দানসীন নারী। কোনও অবস্থাতেই তিনি পর্দা সরিয়ে প্রকাশ্যে তাঁর মুখ দেখাতে নারাজ। যে কারণে তিনি কখনও ক্যামেরার সামনে আসেননি। ওসমান হাদির আম্মাকেও কখনও প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।












Discussion about this post