তাঁকে ধরে রাখা গেলই না। এতো এতো মানুষের ফিরে আসার আকুতি, বিদেশি চিকিৎসকদের চেষ্টা, সমর্থকদের দোয়া – সব ব্যর্থ করে লাখো মানুষকে শোকে ভাসিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল এক তরুণ। দেড় বছরে যার উত্থান উল্কার গতিতে। এই সামান্য সময়ের মধ্যে সে শুষে নিয়েছিল মিডিয়ার সব আলো। এমনকী যেদিন, তাঁকে গুলি করা হল সেদিনও। আর সিঙ্গাপুর থেকে যেদিন এল তাঁর মৃত্যুর খবর, সেদিন শেষবারের মতো। শুধু দেশের নয়, ভিন দেশের গণমাধ্যমের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এই তরুণ-তুর্কি নেতা। আর হাদির এই মৃত্যুর ঘটনায় বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবে প্রবেশ করল এক নতুন ও এক ভয়াবহ যুগে। সেই ভয়াল এক ঝড় বাংলাদেশকে খুবলে খেতে প্রস্তুত।
১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫। ঘড়িতে তখন কাটায় কাটায় পৌনে ১০টা। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় যখন তাঁর হৃদস্পন্দন থেমে গেল, ঠিক সেই মুহূর্তে বাংলাদেশের ইতিহাসের চাকা এক অনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে ঘুরতে শুরু করল। হাদির এই মৃত্যুতে ঘটল আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ, যার লাভার স্রোত পুরো রাষ্ট্রকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। আবারও ধানমন্ডীর ৩২ উত্তাল। ছাড়খার হয়ে গিয়েছে ‘প্রথম আলো’র কার্যালয়। আগুন জ্বলছে, ‘ডেইলি স্টার’ সহ সারা দেশে। থমথমে একটা পরিবেশ। ইতিমধ্যে ভয়ানক ঝড় শুরু হয়ে গিয়েছে। অনুমান ছিল হাদিকে হারিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে যাবে তাঁর অনুসারীরা। হাদি যেমন নিজেও জানতে না যে তিনি যেমন গণ্ডায় গণ্ডায় শত্রু তৈরি করেছেন, আবার বন্ধুর সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তাঁর গড়া ইনকিলাব মঞ্চ আগে থেকেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল হাদির কিছু হলে পুরো বাংলাদেশ অচল করে দেওয়া হবে। হাদির ঘাতকরা গ্রেফতার না হওয়ার পর্যন্ত তারা শাহবাগে অবস্থান করবে। হাদির মৃত্যুর খবর পেতেই ক্ষোভে, রাগে ফেটে পড়েছে জনতা। গভীর রাতেই শাহবাগ পরিণত হয় জনসমুদ্রে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যাত্রাবাড়ি, উত্তরা থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে এসেছে রাজপথে। স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হচ্ছে আকাশ-বাতাস। ‘দিল্লি না ঢাকা’, ‘ঢাকা ঢাকা’, ‘হাদির রক্ত বৃথা যেতে দেব না’, ‘আমরা সবাই হাদি হব, গুলির মুখে কথা বলব।’ চলছে ভাঙচুর, ফ্যাসিস্টিদের চিহ্ন মুছে দেওয়ার কাজ চলছে বলে দাবি করা হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না সব চেয়ে তেজি যোদ্ধাকে হারিয়ে তারা শোকে মূহ্যমান। সময় যত গড়াচ্ছে স্লোগানের আওয়াজ তত তীব্র, ঘন হচ্ছে। এই আওয়াজ স্পষ্ট ঘোষণা দিচ্ছে, দেশ এক গুরুতর সংকটে পড়ে গিয়েছে। এই বিক্ষোভ শুধু শোকের নয়, এই বিক্ষোভ চরম প্রতিশোধের।
এদিকে, শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকারীদের ফেরত না দেওয়া পর্যন্ত ভারতীয় হাইকমিশন বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন এনসিপির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। বৃহস্পতিবার রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এ চরম হুঙ্কার দেন। সারজিস আলম তার পোস্টে বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, শহীদ হাদি ভাইয়ের খুনিদের যতক্ষণ পর্যন্ত না ভারত ফিরিয়ে দিবে ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশন বন্ধ থাকবে।’ এর মধ্য দিয়ে ভারতের সঙ্গে সরাসরি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে গেল সারজিস, হাসনাতরা। এমনটাই বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
গত কয়েকদিন ধরে হাসনাত আবদুল্লাহ এবং ডাকসু নেতাদের মুখ থেকে ভারত-বিরোধী কড়া বক্তব্য শোনা যাচ্ছিল। সেভেন সিস্টার্স বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া কিম্বা ভারতীয় দূতাবাসের ইট খুলে নেওয়ার বক্তব্যে ইতিমধ্যে গরম গোটা অঞ্চল। হাদির মৃত্যু সেই আগুন ঘি ঢেলে দিয়েছে। রাজপথে এখন একটাই দাবি ভারতীয় আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে। অভিযোগ উঠেছে, হাদির খুনিরা সীমান্ত পেড়িয়ে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিয়েছে এবং সেখান থেকেই কলকাঠি নাড়ানো হচ্ছে। যদি তদারকি সরকার দ্রুত খুনিদের গ্রেফতার করতে না পারে, তাহলে বাংলাদেশে ভারতীয় স্বার্থ এবং কূটনৈতকি সম্পর্ক এক ভয়াবহ অচল অবস্থার মুখে পড়বে।












Discussion about this post