শেখ হাসিনার আমলে প্রতিবছর দুর্গাপূজার সময় ভারতে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে হাজার হাজার টন ইলিশ পাঠাতেন। যদিও এটা সৌজন্যমূলক উপহার বলা হলেও, আদতে তা ছিল পুরোদস্তুর রফতানি। আরতকে ডলার গুণেই ইলিশ কিনতে হতো বাংলাদেশ থেকে। এখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি পাল্টে গিয়েছে। এক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। বর্তমানে ভারতের পড়শি দেশ মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে এক তদারকি সরকারের অধীনে। শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর ভারতেই আশ্রয় নিয়েছেন। যার প্রভাবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেকটাই দুর্বল হয়ে গিয়েছে। ফলে এবার দুর্গাপুজোর মরশুমে বাংলাদেশের পদ্মার ইলিশ আসা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। বাংলাদেশের বর্তমান মৎস ও প্রাণীসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার দায়িত্ব গ্রহণের পর ভারতে ইলিশ না পাঠানোর কথাই বলেছিলে। তিনি আবেগতাড়িত গলায় বলেছিলেন, দেশের সাধারণ মানুষ ভালোভাবে ইলিশ খাবে, তারপর বিদেশে রফতানির বিষয়ে বিবেচনা করা হবে।
ফরিদা আক্তারের বলা সেই কথা বাংলাদেশের জনগণের মনে আশার সঞ্চার করেছিল। বাংলাদেশী জনগণ খুব খুশিও হয়েছিলেন। কিন্তু আদতে দেখা গেল বাংলাদেশে ইলিশের পাইকারি ও খুচরো দাম একফোটাও কমেনি। আবার এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই, তুই ফরিদা আখতারই ঘোষণা করলেন, দূর্গা পূজার মরশুমে ভারতে ৩০০০ টন ইলিশ পাঠানো হবে। যার দুটি লট ইতিমধ্যেই ভারতে পৌঁছে গিয়েছে। কি এক সপ্তাহের মধ্যে কি এমন হল, যে বাংলাদেশের তদারকি সরকারকে নিজেদেরই সিদ্ধান্ত বদল করতে হল?
এই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে জেনে নেওয়া যাক, বাংলাদেশ ও ভারতের ইলিশের দাম এখন কি রকম চলছে। বাংলাদেশের দৈনিক সংবাদপত্রগুলি অনুযায়ী, ইলিশের দাম এবছর ব্যাপকহারে বেড়েছে। দশ বছর আগেও যেখানে এক কেজি সাইজের ইলিশের দাম ছিল ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা। এখন তা দু হাজারের ওপরে বিক্রি হচ্ছে। ঢাকা-চাঁদপুর বাজারে সাড়ে ৭০০ গ্রাম থেকে এক কেজি সাইজের ইলিশ ২০০০ থেকে ২২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর এক কেজির ঊপরের সাইজের ইলিশ ২৫০০ টাকা কেজি। সেখানে বর্তমানে ভারতে ইলিশের দাম তুলনামূলক কম। কলকাতা ও হাওড়ার বাজারে ৭৫০ থেকে ১ কেজি সাইজের ইলিশ বিকোচ্ছে ১০০০-১২০০ টাকা কেজি দরে। আর এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে ১৬০০ থেকে ২০০০ কেজি দরে।
বাংলাদেশের বণিকসভাগুলির দাবি, গত এক যুগে বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হলেও বাজারে সরবরাহ বাড়ার ফলে ইলিশের দাম কমেনি। বরং একই সময়ে উৎপাদনের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। ফলে সাধারণ মধ্যবিত্তের খাওয়ার পাত থেকে বিদায় নিয়েছে মহার্ঘ্য ইলিশ। মাছের রাজার ওপর এখন একচেটিয়া অধিকার তৈরি হয়েছে অভিজাতদের। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এতকিছুর পরও কেন দ্বিতীয়বার স্বাধীন বাংলাদেশ ভারতকে ইলিশ রফতানি করার সিদ্ধান্ত নিল? যেখানে একবার বলে দেওয়া হয়েছিল ভারতকে এবার ইলিশ পাঠানো হবে না।
বাংলাদেশের তদারকি সরকারের মতে, বাংলাদেশের বিদেশি মূদ্রার ভাণ্ডার অনেকটাই কমে গিয়েছে। ফলে বাণিজ্য পুনরায় চালু না হলে, বলা ভালো রফতানি না হলে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার ভরবে না। এ ক্ষেত্রে অণুঘটকের কাজ করেছে ভারতের মৎস আমদানিকারক সংগঠন। তাঁরা বাংলাদেশের তদারকি সরকারকে চিঠি দেওয়ার পরই সিদ্ধান্ত বদলায় বাংলাদেশ। যদিও এর পিছনে কারণ অন্য। ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্তের পেছনে কূটনীতির ভূমিকা আছে কী না এমন প্রশ্ন অনেকের। বাংলাদেশ থেকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়মিত দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে ইলিশ রফতানি হয়েছে। তা অনেকটাই বেশি। এবার মাত্র ৩০০০ মেট্রিক টন ইলিশ পাঠানেোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর পিছনে যেমন বিদেশি মুদ্রার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তেমনই অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে আসছে বিদ্যুতের চাহিদার কথাও। বাংলাদেশে ইদানিং বিদ্যুৎ সরাবরাহ কম। তাই বেশিরভাগ হিমঘরই বন্ধ থাকছে। ফলে ইলিশ মজুদ করা যাচ্ছে না। তাই রফতানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশের তদারকি সরকার। আর দ্বিতীয় কারণ হিসেবে উঠে আসছে, ভারতের সঙ্গে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা।
Discussion about this post