“মব জাস্টিস”, এই কথাটার অর্থ হল উত্তাল বা উশৃঙ্খল জনতার বিচার। অধুনা বাংলাদেশে এটাই এখন বহুল প্রচলিত। কোনও নির্বাচিত, গণতান্ত্রিক সরকার না থাকলে যা হয়। প্রথমে সরকারি চাকরিতে কোটা বিরোধী আন্দোলন, পরে গণ অভ্যুত্থান। এরপর একটা নির্বাচিত সরকারের পতন। সম্প্রতি বাংলাদেশে এটাই দেখা গিয়েছে। শেখ হাসিনার পতনের পর সেখানে কয়েকদিন সেনা শাসন ছিল। এরপর আন্দোলনরত ছাত্রদের দাবিমতো একটা তদারকি সরকার গঠিত হয়েছে। কিন্তু পরে বোঝা গিয়েছে বাংলাদেশে আদতে পরিকল্পিত গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, এবং হাসিনা বিরোধী সরকার স্থাপিত হয়েছে। এর যেমন অনেকগুলি উদাহরণ রয়েছে, তেমনই অনেকগুলি কারণ রয়েছে।
শেখ হাসিনা জমানার অবসানের পরই বাংলাদেশজুড়ে শুরু হয়েছে, লাগাতার ভাঙচুর, অরাজকতার পরিবেশ। যার গালভরা নাম “মব জাস্টিস”। আসলে বাংলাদেশে কট্টরপন্থী মুসলিমদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। শেখ হাসিনার আমলে যা বরদাস্ত করা হতো না। আদতে হাসিনার আওয়ামী লিগ সরকার ছিল অনেকটাই উদারপন্থী, ধর্ম নিরেপেক্ষ। যা বাংলাদেশের মতো দেশে অনেকটাই বেমানান। অপরদিকে, হাসিনা ছিলেন ভারতপন্থী। এর পিছনে কারণও রয়েছে। আসলে হাসিনার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সময় বা মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই ভারত স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সমান লড়াই করেছে। তাই আওয়ামী লিগ অনেকটাই ভারতপন্থী। অপরদিকে, আওয়ামী লিগের বিরোধী বলে পরিচিত বিএনপি বা জামাতের মতো দল প্রকাশ্যেই ভারত বিরোধী, বলা ভালো পাকিস্তানপন্থী। ফলে ছাই চাপা আগুনের মতো ভারত বিরোধিতা একটা ছিলই। যেটাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে গণ অভ্যুত্থান ঘটানো সম্ভব হয়েছে বলেই মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ। আর সম্প্রতি বাংলাদেশের তদারকি সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসও মার্কিন যুক্তরাষ্ট সফরে তা স্বীকার করেছেন।
শেখ হাসিনার পতনের পর উন্মত্ত সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রেহাই পাননি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী পদে পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করার পরই বাংলাদেশে শুরু হয় অরাজকতা। প্রথমে গণভবনের দখল নেওয়া, এরপর মুজিবর রহমানের সংগ্রহশালায় আগুন দেওয়া। তারপর বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবরের মূর্তি ভাঙার মতো ঘটনা গোটা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে। আবার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মূর্তি ভাঙা হয়েছে নির্বিচারে। এখানেই শেষ নয়, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সিনেমা পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের পৈত্রিক ভিটে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশিষ্ট লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পৈত্রিক ভিটেও ছাড় পায়নি কট্টরপন্থীদের হাত থেকে। এবার আক্রান্ত হলেন লালন ফকির।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের খবর, গত রবিবার মধ্যরাতে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায় লালন আনন্দধামে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। এখানেই ছিল বিখ্যাত কবিয়াল তথা দার্শনিক লালন ফকিরের দুষ্প্রাপ্য কিছু ছবি, বেশ কিছু মূল্যবান গ্রন্থ ও জার্নাল। এছাড়া ছিল তাঁর ব্যবহৃত একতারা, দোতারা, বায়া, জুড়ি, গিটারসহ বেশ কিছু বাদ্যযন্ত্র। এখানেই ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভাস্কর্য, যেটিও রেহাই পায়নি দুবৃত্তদের হাত থেকে। এই ধরণের কাজ কে বা কারা করছে, সেটা সকলের কাছেই পরিস্কার। কিন্তু একমাসের অধিক সময় হয়ে যাওয়ার পরও মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে তদারকি সরকার সে ভাবে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। যা নিয়ে ভারত ক্রমাগত আন্তর্জাতিক মহলে দাবি করে আসছে।
সূত্রের খবর, গত ১২ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আনন্দধামে হামলার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। কয়েক দিন আগে একদল দুর্বৃত্ত আনন্দধামের সিসি ক্যামেরাগুলো ভাঙচুর করে। আর এখন এ ঘটনা ঘটল। অথচ বাংলাদেশের পুলিশ বা সেনা কোনও আগাম সতর্কতা নেয়নি। অথচ ঘটনার পর ভাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহম্মদ মোকছেদুর রহমান দাবি করেছেন, ‘ঘটনাটি আমার জানা নেই। বিষয়টি জেনে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে লালন ফকিরের স্মৃতির উদ্দেশ্যে লালন আনন্দধাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সদরপুর সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সৈয়দ জাহিদ হাসান। এখন সেটাই মাটিতে মিশিয়ে দেওয় হয়েছে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পর থেকে এখনও পর্যন্ত, সেখানে বসবাসকারী সংখ্যালঘু হিন্দু বা অন্যান্য সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনা ঘটেই চলেছে। হিন্দুদের ঘরবাড়ি. মন্দির ভাঙচুর করা হচ্ছে। এমনকি গির্জা বা বৌদ্ধ মঠের ওপরও চলছে আক্রমণ। শুধু তাই নয়, সুফিদের মাজারেও চলছে লাগাতার হামলা। বাংলাদেশে বিগত কয়েকদিনে বহু মাজারে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা শোনা গিয়েছে। এর পিছনে উগ্র মৌলবাদী সংগঠনগুলির হাত রয়েছে। আর বাংলাদেশের বর্তমান তদারকি সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই ধরণের কট্টরপন্থী মৌলবাদী সংগঠনের নেতাদের জেলমুক্তির নির্দেশ দিয়েছিল। ফলে বোঝাই যাচ্ছে কার উদ্দেশ্য কি।
Discussion about this post