ইতিহাস বুঝি এভাবেই ফিরে ফিরে আসে। সালটা ২০১০, সেবার ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল চালু করেছিলেন শেখ হাসিনার সরকার। মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যায় দোষী এমন অনেক রাজাকার নেতার ফাঁসির সাজাও হয় এই আদালতে। ২০২৪ সালে সেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালেই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করল। এ ক্ষেত্রে হাসিনার বিরুদ্ধে রয়েছে গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী মারাত্মক সব অপরাধের অভিযোগ।
জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশের আন্দোলনের সময় নিহত দুই ছাত্রের পরিবার এই ট্রাইবুনালে হাসিনা-সহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন। এর ভিত্তিতেই এই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে অপরাধ ট্রাইবুনালের বিচারক। অপরদিকে, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর সরকারের ১০০ দিনের অনুষ্ঠানে দাবি করেছেন, শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনবেন, সেই সঙ্গে হাসিনার বিগত ১৫ বছরের ঘটে যাওয়া সমস্ত অপরাধের বিচার করা হবে বলেও তিনি জানান। এমনকি বাংলাদেশের তদারকি সরকার যে ভারতের কাছে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের দাবিও জানাবে, সেটাও বলেন মুহাম্মদ ইউনূস।
কিন্তু ইউনূস চাইলেই তো হল না! ভারতের কাছে যথাযথভাবে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইতে হবে। আসলে শেখ হাসিনার আমলেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আসুন এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক, বাংলাদেশ কোন কোন ধারায় শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইতে পারে। ২০১৩ সালে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মূলত ফেরারি অভিযুক্ত এবং দোষী সাব্যস্ত অপরাধীদের গ্রেফতার করে ফিরিয়ে আনতেই এই চুক্তি। সেই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কংগ্রেসের মনমোহন সিং। আসলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আলফার মতো বেশ কয়েকটি জঙ্গি গোষ্ঠীর নেতারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে ভারতে নাশকতার কাজ চালাচ্ছিলেন। সে সময় বাংলাদেশে ক্ষমতায় ছিল খালেদা জিয়ার বিএনপি-জোট। তৎকালীন ভারত সরকার যে কোনও মূল্যে এই নাশকতা ঠেকাতে চাইছিল। এরপর হাসিনা বাংলাদেশের ক্ষমতায় ফিরতেই ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির আওতায় ২০১৫ সালে আলফা শীর্ষ নেতা অনুপ চেতিয়াকে বাংলাদেশ হস্তান্তর করে ভারতের হাতে। পাশাপাশি বাংলাদেশও বেশ কয়েকজন অপরাধীকে প্রত্যর্পণ চেয়ে বাংলাদেশে ফেরত নিয়েছে। এবার কি তবে হাসিনার পালা?
বিশষজ্ঞদের দাবি, শেখ হাসিনার নামে দুটি মামলা দায়ের হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে। যার জেরে তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে হাজির করানোর জন্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। কিন্তু এখনও হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করেনি আদালত। চুক্তির একটি ধারায় যেমন বলা হয়েছে, আদালতের জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানাই যথেষ্ট। সাক্ষ্য প্রমান দাখিল করার দায় নেই আবেদনকারী দেশের। সে ক্ষেত্রে হাসিনাকে প্রত্যপর্ণ চেয়ে এই গ্রেফতারি পরোয়ানাই যথেষ্ট। এদিকে মুহাম্মদ ইউনূস গত ১৭ নভেম্বর দাবি করেছিলেন ভারতের কাছে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ দাবি করা হবে সেই বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তির বলে। কিন্তু এখনও তা করা হয়নি বলেই কূটনৈতিক মহলের খবর। যদি বাংলাদেশ সরকার সেই আবেদন করে, তাহলে ভারত কি তাতে সাড়া দেবে?
বিশেষজ্ঞদের দাবি, এই প্রত্যর্পণ চুক্তির ৬ এর ১ ধারা অনুযায়ী রাজনৈতিক কারণে অভিযুক্ত হলে তা কোনও পক্ষ অগ্রাহ্য করতে পারে। সূত্রের খবর, ভারত সরকার এই ধারা প্রয়োগ করতে পারে তাঁদের দীর্ঘকালীন বন্ধু শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে হাসিনার বিরুদ্ধে ১০০টির বেশি মামলা চলছে, যার বেশিরভাগটাই হত্যা, গণহত্যা, গুম করা, অপহরণের মতো গুরুতর অভিযোগ। কিন্তু প্রত্যর্পণ চুক্তির ৬ এর ১ ধারা অনুযায়ী হত্যা, গণহত্যা, গুম করা, অপহরণ, বিস্ফোরণ ঘটানো বা সন্ত্রাসবাদের মতো ঘটনা রাজনৈতিক কারণ হতে পারে না। তবে ভারতের তরফে আগেই জানিয়ে রাখা হয়েছে, হাসিনার বিরুদ্ধে যে সমস্ত অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা কাল্পনিক বা রাজনৈতিক উ্দ্দেশ্যে নেওয়া। ফলে বাংলাদেশ চাইলেই ভারত হাসিনাকে ফেরত পাঠাবে না।
Discussion about this post