আমাদের প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবাদী ছাত্রদের এক আন্দোলনকে প্রতিহত করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত গদিচ্যুত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, তাকে দেশ পর্যন্ত ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। আপাতত শেখ হাসিনা ভারতের নিরাপদ আশ্রয় রয়েছেন। শেখ হাসিনার এরকম পরিণতি কেন হল, তা নিয়ে নানান বিশ্লেষণ চলছে। গণমাধ্যম ও সমাজ মাধ্যমের নানা বিশ্লেষণে উঠে আসছে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী মনোভাব এবং দমনমূলক পদক্ষেপের বিষয়টি। বাংলাদেশের প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গ। ভূ-রাজনৈতিক সীমানা বিভেদ থাকলেও বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে মিল অনেক। ঠিক যেমন এখন গোটা পশ্চিমবঙ্গেই এক আন্দোলন চলছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের মিল খোঁজার চেষ্টা ভুল। কিন্তু দুই আন্দোলন দমনের মধ্যে বিস্তর মিল রয়েছে। ঠিক যেন শেখ হাসিনার ছায়াই এখানে প্রতিফলিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে প্রথমদিকে অতি সাধারণ এক আন্দোলন শুরু হয়েছিল চাকরি ক্ষেত্রে কোটার বিরোধিতা নিয়ে। মূলত ঢাকা হাইকোর্টের একটি রায়ের পরিপ্রেক্ষিতেই এই আন্দোলনটা দানা বাঁধছিল। কিন্তু সেই আন্দোলন তীব্রতর হতে শুরু করে একটি ঘটনার পর। সেটা হল, আওয়ামী লিগের ছাত্র সংগঠন ছাত্র লিগ মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর ঢুকে আন্দোলনরত পড়ুয়াদের নির্বিচারে মারধোর করে। এরপরই আন্দোলন তীব্র হয়েছিল এবং ঢাকা থেকে তা ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা বাংলাদেশে। এখানেও যেন সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। কলকাতায় আর জি কর হাসপাতালে এক মহিলা চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হয় ৯ আগস্ট সকালে। ঘটনার পর থেকেই কলকাতা পুলিশের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ সামনে আসে। খুনের ঘটনা প্রথমে আত্মহত্যার ঘটনা বলা, পরিবারকে দীর্ঘক্ষন বসিয়ে রাখা এবং তড়িঘড়ি ময়নাতদন্ত করা। জুনিয়ার ডাক্তারদের আন্দোলন ঠেকানোর মরিয়া প্রচেষ্টা ইত্যাদি কার্যকলাপ। এরপরও যখন গত ১৪ আগস্ট একটা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ আন্দোলনে নামে মহিলারা, সেইদিন রাতেই আর জি কর হাসপাতালে হামলা। ফলে আন্দোলন আরও বড় আকার নেয়। বিশেষজ্ঞদের কথায়, কোথাও যেন একটা মিল রয়েছে দুই দেশের আন্দোলন দমনে।
আর জি কর হাসপাতালের ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা দূরে সরিয়ে রেখেও কয়েকটি বিষয় নিয়ে বলা যায়। সেটা হল রাজ্য প্রশাসন ও কলকাতা পুলিশের অতি সক্রিয়তা। যেমন কলকাতা পুলিশ ১৪ আগস্ট রাতের ঘটনা নিয়ে একটি টুইট করেছিল যে কয়েকজন নির্দিষ্ট দলীয় পতাকা নিয়ে আক্রমণ হয়েছে। যদিও বিতর্কের পর সেই টুইট মুছে ফেলা হয়।
বাংলাদেশে পুলিশ ও প্রশাসনের মধ্যে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ট একটি বাহিনী ছিল। বিশেষ করে ৱ্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন বা ৱ্যাব। অভিযোগ আন্দোলন দমন করতে শেখ হাসিনা এঁদের হাতে যথেষ্টই ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে, আন্দোলন দমনের নামে নির্বিচারে গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ।
পশ্চিমবঙ্গে আর জি কর হাসপাতালে কর্মরত এক চিকিৎসক পড়ুয়ার ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে উত্তাল। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে ওই নৃশংস হত্যাকান্ডের নিন্দা করছেন। তিনি নিজেও এর দ্রুত বিচার চাইছেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে বিস্তর ফারাক। পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজ এটা মেনে নিতে পারছেন না। পাশাপাশি আচমকা একেকটা আন্দোলন মাথাচারা দিয়ে উঠছে। যাকে বর্তমান সমাজের পরিভাষায় “ফ্ল্যাস মব” বলা হয়। যে আন্দোলনের কোনও মাথা নেই, রাজনৈতিক রঙ বা পতাকা নেই। অথচ হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পথে নামছেন। আর সেই আন্দোলন দমন করছে পুলিশ। আর এরপরই একটা ব্যাখ্যা সামনে আনা হয়েছে, সেটা হল এই আন্দোলন রাম-বামের চক্রান্ত। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পথে নেমে এখানে বলেছেন, এই আন্দোলন করছে বিজেপি ও বামফ্রন্ট। ঠিক যেমনটা বলেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কোটা নিয়ে তিনি বলেছিলেন চাকরি মুক্তিযোদ্ধার উত্তরাধিকাররা পাবে নাকি রাজাকারদের নাতিপুতিরা! ফলে আন্দোলন আরও তীব্রতর হল। কলকাতার আন্দোলনও প্রায় একই। যেখানে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন হচ্ছে, ঠিক অনেকটা ফ্ল্যাশ মব তৈরি হচ্ছে, প্রত্যেকেরই একই দাবি, আর জি করের বিচার চাই। যেখানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই প্রশাসনিক প্রধান হয়ে এই একই দাবি তুলছেন, সেখানে একই দাবী তোলা আন্দোলনকারীদের তিনি দমন করছেন পুলিশ প্রশাসনের সাহায্যে। যে ভুলটা শেখ হাসিনা করেছিলেন, অনেকটা সেই একই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।
প্রথমে মহিলাদের রাত দখল কর্মসূচি, সেই রাতেই আর জি কর হাসপাতলে আক্রমণ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, এটা বাম রামের চক্রান্ত।
বাইট – মমতা
এরপর ডার্বি ম্যাচ বাতিল নিয়ে ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান সমর্থকদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। এখানেও কোনও নেতা নেই কোনও দলীয় পতাকা নেই , আন্দোলন হল, রাস্তা দখল হল। কখনও চিকিৎসকরা আন্দোলন করছেন, কখনও টলিউডের অভিনেতারা, কখনো বার কাউন্সিল। কোন আন্দোলনেই নেই রাজনীতির পতাকা। কিন্তু সব আন্দোলনের রোখার চেষ্টা করছে পুলিশ। ঠিক যেমনটা হয়েছিল ঢাকায়, গোটা বাংলাদেশে। পড়শি দেশে আন্দোলনের প্রভাবে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন শেখ হাসিনা। সেই একই ভুল করে চলেছেন, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রশাসনে তার অধীনে থাকা আইপিএস, আইএএস আধিকারিকরা তাকে কি বোঝাচ্ছেন সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। আরজি করের ওই মহিলা চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হয়েছে ১০ দিন হয়ে গেল, আন্দোলন থামার নাম নেই, কোনও রাজনৈতিক দলের পতাকা নেই। নেই কোনও নেতৃত্ব। তবুও আন্দোলন চলছে। ঠিক যেমনটা চলেছিল পড়শী দেশ বাংলাদেশ
Discussion about this post