বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক চিন সফরে করা ভারতের সেভেন সিস্টার্স নিয়ে মন্তব্য নিয়ে ভারত বেশ কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা সবাই জানি, ব্যাংককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে একটা সাক্ষাৎ হয়েছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং মুহাম্মদ ইউনূসের। সেই সাক্ষাৎপর্ব মিটতেই ভারত বাংলাদেশকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে মোক্ষম জবাব দিয়েছে বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু ভারতের এখন যাবতীয় মাথাব্যাথার কারণ হল লালমনিরহাট বিমানঘাঁটি। সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশদের দ্বারা নির্মিত এই বিমানঘাঁটি আজ পুরোপুরি পরিত্যাক্ত। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের দাবি, লালমনিরহাট বিমানঘাঁটির রানওয়েতে বিমান নয়, এখন গরু-ছাগল চড়ে বেড়ায়। কিন্তু বর্তমান মুহাম্মদ ইউনূসের তদারকি সরকার এই পরিত্যাক্ত বিমানঘাঁটিকেই এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমানঘাঁটি বানাতে উদ্যোগী। আর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এই নির্মানের জন্য মুহাম্মদ ইউনূস চিনের সাহায্য চেয়েছেন। এমনকি চিনের একটি ঘাঁটি তৈরি হলেও তাঁর আপত্তি নেই বলেই দাবি করছে একাধিক সংবাদমাধ্যম। এটাই ভারতের মাথাব্যাথার কারণ।
লালমনিরহাট বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি শহর। যা ভারতের কুচবিহার এবং জলপাইগুড়ি জেলার খুব কাছে। এছাড়া লালমনিরহাট থেকে ভূটানের দূরত্বও বেশি নয়। সবচেয়ে বড় বিষয় হল, লালমনিরহাট থেকে ভারতের “চিকেন নেক” শিলিগুড়ি করিডোরের দূরত্ব মাত্র ১০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের আভ্যন্তরীণ সুরক্ষা এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্য বা সেভেন সিস্টার্সের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাত্র ২২ কিলোমিটার এই অংশ দিয়েই সিকিম-সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে যাবতীয় পণ্য এবং যাত্রীদের আনাগোনা হয়। ফলে কোনও ভাবে ভারতের শত্রুপক্ষ এই চিকেন নেক কেটে দিলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে ভারতের আটটি রাজ্য। যেটা ভারত কোনও ভাবেই হতে দেবে না।
এবার আসা যাক লালমনিরহাট বিমানঘাঁটি নিয়ে মুহাম্মদ ইউনূসের পরিকল্পনা এবং চিনের নজর সম্পর্কে। চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিংপিন এই মুহূর্তে খুবই চাপে। কারণ চিনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প কার্যত জলে যেতে বসেছে। কোটি কোটি বিলিয়ন ডলার ডুবে গিয়েছে পাকিস্তান ও মিয়ানমারে। চিন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর হল চিনের ওয়ান বেল্ট-ওয়ান রোড প্রকল্পের অধীনে চলা সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্খী প্রকল্প। যা চিনের শিনচিয়াং প্রদেশ থেকে পাক অধিকৃত কাশ্মীর, বেলুচিস্তান প্রদেশ হয়ে পাকিস্তানের গওদর বন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত। মোট ৬২ বিলিয়ন ডলার ব্যায়ের এই অর্থনৈতিক করিডোর দিয়ে চিন মূলত পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপে বাণিজ্য করছিল।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে বিদ্রোহের আঁচে এই চিন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অপরদিকে চিনের ইউনান প্রদেশ থেকে মিয়ানমারের মন্দালয় হয়ে দক্ষিণের কিউপিও বন্দরে গিয়ে শেষ হচ্ছে চিন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর। এটি বেল্ট অ্যান্ড রোজ ইনিশিয়েটিভের আওতায় তৈরি করছিল চিন। মূলত সড়ক ও রেলপথের পাশাপাশি পাইপলাইনের মাধ্যমে মিয়ানমারের তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস পরিবহনের পরিকল্পনা ছিল চিনের। এই প্রকস্পের খরচ ধরা হয়েছিল প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে আরাকান আর্মি এবং চিন প্রদেশে চিন লিবারেশন আর্মির বিদ্রোহে এই প্রকল্প এখন অথৈ জলে। তাই এবার চিনের নজর পড়েছে বাংলাদেশের ওপর।
আর এই সুযোগটাই নিতে চাইছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি ভারতকে চাপে রাখতেই চিনকে আহ্বান করেছেন বাংলাদেশে তাঁদের অর্থনীতি বিস্তার করার জন্য। আর মাঝখানে রয়ে গিয়েছে ভারতের সেভেন সিস্টার্স। সেটাকে অস্বীকার করেই চিনকে আহ্বানের মধ্যে দিয়েই ইউনূসের দূরভিসন্ধি বোঝা যাচ্ছে। তিনি বাংলাদেশের মোংলা বন্দর এবং লালমনিরহাটের পরিত্যাক্ত বিমানবন্দরটি চিনকে আধুনিকীকরণের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি জানেন, এই মুহূর্তে চিনও চাইছে একটা নতুন সমুদ্র পথের সন্ধান পেতে, আর ভারতের চিকেন নেকের নাকের ডগায় একটা সামরিক বেস তৈরি করার সুযোগ পেতে। তবে ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এই মুহূর্তে মার্কিন শুল্কচাপে হাঁসফাঁস করা চিন কোনও ভাবেই চাইবে না ভারতকে চটাতে।
তাই মুহাম্মদ ইউনূস চিন সফর সেরে দেশে ফেরার পরই চিন বারবার ভারতের দিকে বন্ধত্বের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। অপরদিকে ভারতও এক ফোঁটা ছাড় দিতে নারাজ চিনকে। তাই লালমনিরহাট নিয়ে কড়া নজর রাখছে ভারত। কারণ, এর আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শীর্ষকর্তা থেকে শুরু করে আইএসআই কর্তারা ঘুরে গিয়েছেন লালমনিরহাট বিমানবন্দরে। এবার চিন যদি রাজি হয় তাহলেই ভারতের বিপদ। সেই কারণেই শিলিগুড়ি করিডোরে রীতিমতো রণসাজে সেজে উঠেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম-সহ অত্যাধুনিক রাফাল যুদ্ধবিমান তৈরি রাখা হয়েছে। মূল বার্তা চিনকেই দিতে চায় ভারত, যে লালমনিরহাটের দিকে হাত বাড়াবেন না।
Discussion about this post