ছাত্র আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর পতন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতায় আসা, চার মাসের বেশি সময় পেরিয়ে যাওযার পরও দেশে নির্বাচনের কোনও নামগন্ধ না থাকা। বিগত সাত মাসে বাংলাদেশে ঘটে চলেছে অভূতপূর্ব সব ঘটনা। তবে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে আদৌ বাংলাদেশের কতটা পরিবর্তন হল? সত্যিই এমন কোনও সংস্কার করা সম্ভব কি না, যাতে ক্ষমতাসীন কেউ স্বৈরাচার হয়ে উঠতে না পারে? কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কাঁটাছেঁড়া করতে গিয়ে উঠে আসছে একটাই তত্ত্ব, “থোর বড়ি খাড়া-খাড়া বড়ি থোর”। ওয়াকিবহাল মহল মনে করছেন, এই সব প্রশ্ন নিয়ে এখনই বিতর্ক করার সময় আসেনি। কিন্তু একটা প্রবাদের কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, সেটা হল “সকাল বুঝিয়ে দেয় দিনটা কেমন যাবে”। কেউ কেউ বলছেন, ওলট-পালট সময় ধীরে ধীরে নিশ্চয়ই স্থিত হবে। কিন্তু কেউ কেউ এটাও বলছেন, যেভাবে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন চলছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে আগামীদিন জঙ্গিরাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে ভারতের পড়শি দেশ। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে এখন বাংলাদেশে কি কি হচ্ছে?
আসলে গণ অভ্যুত্থানের পিছনে মহৎ উদ্দেশ্য যেটাই থাক, আসল উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে গদিচ্যুত করা এবং আওয়ামী লিগকে নিশ্চিহ্ন করা। সেটা এখন দিনের আলোর মতো পরিস্কার। কেন আওয়ামী লিগ ও শেখ হাসিনাকে পদচ্যুত এবং দেশছাড়া করার পরিকল্পনা হয়েছিল? শেখ হাসিনা ছিলেন ভারত বন্ধু, তার থেকেও বড় বিষয় হল তিনি অনেকটাই ধর্মনিরপেক্ষ নীতি নিয়ে চলতেন। ফলে বাংলাদেশের কট্টরপন্থী মৌলবাদী সংগঠনগুলি হালে পানি পাচ্ছিল না। এমনকি শেখ হাসিনার আমলে বেশ কয়েকটি মৌলবাদী সংগঠনকে জঙ্গি তকমা দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। তাঁদের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করে জেলে ঢোকানো হয়েছিল। এটা কোনও ভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন বাংলাদেশের এক শ্রেণির মানুষজন। ফলে তাঁকে হঠানোর পরিকল্পনা শুরু হয়। অপরদিকে আমেরিকার নজর ছিল বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের উপর। যেখানে তাঁরা সামরিক ঘাঁটি তৈরি করতে চেয়েছিল চিনকে চাপে রাখার জন্য। এখানেও বাদ সাধেন শেখ হাসিনা। ফলে তিনি আমেরিকার নেক নজরে ছিলেন না। যা হাসিনা নিজেও বারবার দাবি করেছিলেন। ফলে হাসিনাকে সরানোর চক্রান্তে আমেরিকাও সামিল হয় বলে অনেকের অভিমত। তাই এই ছাত্র আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান অনেকটাই পরিকল্পিত বলেই মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহলের একটা বড় অংশ।
এখন প্রশ্ন হল নতুনভাবে স্বাধীন হওয়া এই বাংলাদেশ কি কি পেল?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে প্রথমেই যেটা উঠে আসে, সেটা হল শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লিগের নেতাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দায়ের হওয়া এবং যারা দেশ ছেড়ে পালাতে পারেননি তাঁদের বিচার শুরু হওয়া। এরপর যেটা হয়েছে তা হল, বিএনপি, জামাত-সহ আওয়ামী লিগ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির নেতাদের সাত খুন মাফ হওয়া। তাঁরা একে একে অভিযোগমুক্ত হয়ে এখন দলে দলে দেশে ফিরছেন। তিন নম্বর পয়েন্ট আরও মারাত্মক, সেটা হল এক সময় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিসেবে যারা যারা চিহ্নিত হয়েছিল, তাঁদের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়া। এবং বেশ কয়েকজন শীর্ষ জঙ্গিনেতার বেকসুর জেলমুক্তি। তার পর আসছে, দিনে দিনে বাংলাদেশে জেহাদি শক্তিগুলির বৃদ্ধি এবং সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর হামলা, অত্যাচারের ঘটনা বাড়তে থাকা। এমনকি ভারত-সহ আন্তর্জাতিক মহল থেকেও এই বিষয়ে উদ্বেগ ও চাপ এলেও বাংলাদেশের তদারকি সরকার নির্বিকার।
অন্যদিকে আজকের দুনিয়ায় একটি দেশের ভিতরকার এই রকম পরিস্থিতি কেবল তার নিজের সীমানাতেই আটকে থাকতে পারে না। বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিভিন্ন বাস্তবতায় এর প্রভাব বিস্তৃত হতে বাধ্য। যেমন মুহাম্মদ ইউনূসের আমলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক একেবারেই তলানিতে এসে ঠেকে। যদিও এটা অবসম্ভাবী ছিল। আর এর প্রভাবে আন্তর্জাতিক মহলে আরও চাপে পড়তে শুরু করে বাংলাদেশ। ভারতের ভিসা নীতির প্রভাবে কার্যত কোনঠাসা হয়ে যায় বাংলাদেশ। সংখ্যালঘু হিন্দুদের নির্যাতন প্রসঙ্গে প্রথমদিকে আমেরিকার বাইডেন প্রশাসন নিরব থাকলেও পরে তা আর হয়নি। অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় বাংলাদেশের ইউনূস প্রশাসনকে গভীর চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। এবার আসা যাক চিনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে। শেখ হাসিনা ভারত ও চিন দুই যুযুধান দেশের সঙ্গেই সূসম্পর্ক বজায় রাখছিলেন। কিন্তু মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের সঙ্গে যেমন বৈরিতার সম্পর্ক রাখছেন, তেমনই চিনকেও পাশে পাচ্ছেন না। ভারতের মাস্টারস্ট্রোকে চিন এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশ ইস্যুতে নিরব ভূমিকা পালন করছে। এর পর ইউনূসের শিয়রে এসে গেল আরেক সংক্রান্তি। সেটা হল মিয়ানমার সীমান্তে আরাকান আর্মির উত্থান। ফলে একদিকে যেমন তাঁদের হাতে বাংলাদেশের জমি বেহাত হওয়ার ভয় রয়েছে, তেমনই নতুন করে লাখ লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ভয় তাড়া করে বেরাচ্ছে মুহাম্মদ ইউনূসকে। ফলে বাধ্য হয়ে তিনি পাকিস্তানের শরণাপন্ন হচ্ছেন বেশি করে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূল করে ফুটো নৌকায় চেপে বসেছেন মুহাম্মদ ইউনূসের তদারকি সরকার। যার পরিনাম অচিরেই টের পাবেন তাঁরা।
Discussion about this post