তীব্র বিদ্যুৎ সংকটে ভুগছে বাংলাদেশ। একদিকে ডলার সংকট, অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে অবনতি। দুইয়ে মিলে গোটা বাংলাদেশ জুড়ে এখন বিদ্যুতের হাহাকার। ঢাকা, রাজশাহী, যশোরের মতো বড় শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ মোটের ওপর ঠিক রাখা হলেও, কোপ পড়ছে ছোট ও মাঝারি শহরগুলিতে। আর গ্রামাঞ্চলে তো এখনও সেভাবে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি, বা বিদ্যুতের খুঁটি, তার থাকলেও সেখানে সরবরাহ অতি নগন্য। যা বাংলাদেশী নাগরিকদের একটা ক্ষোভের কারণ। কিন্তু কেন বাংলাদেশে বিদ্যুতের এত হাহাকার? বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হলেও চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াটেরও কম। তাহলে অন্য দেশ, বলা ভালো ভারত থেকে কেন বিদ্যুৎ কিনতে হয় বাংলাদেশকে? এর পিছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি কারণ। তবে বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে নেওয়া অপরিকল্পিত সরকারি নীতিকে।
জানা যাচ্ছে, শেখ হাসিনা বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশে অনেকগুলি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করেছেন। এছাড়া কয়েকটি নির্মাণধীন রয়েছে। কিন্তু অভিযোগ, এই বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলি জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত না করে অথবা চাহিদা বিবেচনা না করেই নির্মাণ করা হয়েছিল। ফলে জ্বালানি আমদানি করে এই কেন্দ্রগুলি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে খরচ বিপুল পরিমান বেড়েছে। ফলে বিদ্যুতের দামও বাড়ছে সেই পরিমানে। সংশ্লিষ্ট মহল বলছে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকটের মূল সমস্যা ডলার সংকট। একে কেন্দ্র করেই অন্য সমস্যাগুলো প্রকট হয়েছে। কারণ বাংলাদেশে জীবাশ্ম জ্বালানি, বিশেষ করে কয়লা নেই। প্রাকৃতিক গ্যাস থাকলেও তা বিপুল পরিমানে নয়। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলির জন্য জ্বালানি বিদেশ থেকেই আমদানি করতে হয়।
আর এর জন্য খরচ হয় বিপুল পরিমান বিদেশী মুদ্রা বা ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশ চরম আর্থিক সংকটে ভুগছে। তাই বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা বেশি ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে ২০২২-২৩ সালকে উল্লেখ করা যায়। ওই অর্থবছরে জ্বালানি আমদানির জন্য অতিরিক্ত ১৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে বাংলাদেশ। অপরদিকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ আসে গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে।গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আছে প্রায় বারো হাজার মেগাওয়াট। অথচ এখন পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। কিন্তু বাংলাদেশ এর প্রায় অর্ধেক দামে ভারত থেকে বিদ্যুৎ কিনতে পারছে। যা অনেকটাই লাভজনক। কিন্তু মুহাম্মদ ইউনুসের তদারকি সরকার ডলার সংকটের কারণে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি কমাতে বাধ্য হচ্ছে।
মূলত ভারতের তিনটি উৎস থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয় বাংলাদেশে। যার প্রধান উৎসটি হল ভারতের ঝাড়খণ্ডের আদানি পাওয়ার প্ল্যান্ট। দ্বিতীয়টি ডিভিসি ও এনটিপিসি। আর তৃতীয়টি ত্রিপুরা সরকার। কিন্তু বিগত সময়কাল থেকেই আদানি, ত্রিপুরা সরকার ও এনটিপিসির বিপুল বকেয়া রয়েছে বাংলাদেশের কাছে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভেড়ামারা এইচডিডিসি সাবস্টেশনের মাধ্যমে আগে প্রতিদিন ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হতো। কিন্তু ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে তা সাড়ে চারশো-পাঁচশো মেগাওয়াটে নেমে এসেছে। আবার ত্রিপুরা থেকে প্রতিদিন ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনতো বাংলাদেশ। কিন্তু বর্তমানে তা নেমে এসেছে মাত্র ৫০ থেকে ৬০ মেগাওয়াটের মধ্যে। অপরদিকে আদানি গ্রুপের ঝাড়খণ্ডের গোড্ডার উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে প্রতিদিন ১৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ হতো। কিন্তু বিশাল টাকা বকেয়া পড়ে যাওয়ায় আদানি গ্রুপ বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রফতানি কমিয়ে অর্ধেক করে দিয়েছে। বাংলাদেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “চুক্তিটা নিয়ে অনেক কথা হতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে আদানির সরবরাহ যদি বন্ধ হয়ে যায় তবে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। কথা হচ্ছে যে আদানি আটশ মিলিয়ন ডলার পাবে এটাতো তার চুক্তি অনুযায়ী প্রাপ্য। এখন আমরা যদি না দিতে পারি টাকাটা, ওরা কতদিন বাকিতে বিদ্যুৎ দেবে?”
Discussion about this post