তৈরি করা হয়েছিল ২০ সদস্যের এক কিলিং স্কোয়াড। এটা ছিল কোটি কোটি টাকার একটি মেগা প্রজেক্ট। প্রজেক্টের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তারা যদি তাদের মিশনে ফেল করে, তাহলে তাদের জেলের ভাত আগে থেকেই তৈরি রাখা হয়েছিল। হাতছাড়া হত কোটি কোটি টাকা। এই শুটিংয়ে একা ফয়সাল নয়, টাকার লোভ সামলাতে পারেনি ফয়সালের বাবা হুমায়ুন কবীর, মা, তাঁর স্ত্রী সাহিদা পারভিন সামিয়া। এই প্রজেক্টে তারা তাদের পারিবারিক ব্যবসায় রূপান্তরিত করে। তদন্ত যত গভীর হচ্ছে, ততই বেরিয়ে আসছে ভয়ংকর সব তথ্য।
তদন্তে উঠে এসেছে, এই গুলি-কাণ্ডে কোনও ছিচকে মস্তান জড়িত নয়। ভাড়া করা হয়েছিল শার্প শুটারদের। যারা জানে কোন সময় ট্রিগারে চাপ দিলে গুলি কোন জায়গায় লাগবে। সামাজিক মাধ্যমে যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে, সেই ভিডিও মন দিয়ে লক্ষ্য করলে সেটা স্পষ্ট হয়ে যায়। জানা গিয়েছে, খুনের পরিকল্পন করা হয়েছিল, গত তিন মাস ধরে। উদ্দেশ্য একটাই। কোনওভাবেই যেন মিশন ফেল না করে। ওসমান হাদি কোনও সাধারণ লোক নয়। সে কারণে বাঘা বাঘা শুটারদের ভাড়া করা হয়। একাধিকবার করা হয়েছে রেইকি। চূড়ান্ত ছক কষা হয় ঘটনার আগের রাতে। কোথায় বসে হয়েছে চূড়ান্ত নকসা?
সাভারের গ্রিন রিসর্ট হয়ে ওঠে এই কিলিং মিশনের কন্ট্রোলরুম। রিসর্টের একটি ঘর ভাড়া করা হয়েছিল। ঘরের নম্বর ২০৪। সেই ঘরে ফয়সালের সঙ্গে ছিল আরও দু’জন। এরা হলেন বাংলাদেশের আন্ডারওয়ার্ল্ডের কথিত গড মাদার সুব্রত বাইনের মেয়ে এবং মেয়ের বান্ধবী মারিয়া আখতার। অপরাধ জগতের অলিগিল তাঁর নখদর্পণে। সেই ২০৪ নম্বর রুম থেকে ফয়সাল ভারতে থাকা তাঁর নেটওয়ার্কের সঙ্গে কথা বলে হামলার ফাইনাল ব্লু প্রিন্ট ঠিক করে নেয়। সেই ব্লু প্লিনট সেই রাতে মারিয়াকে পড়ে শোনায় ফয়সাল। মারিয়া সে বলেছিল, কাল সকালে এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে, যা দেখে গোটা দেশ কাঁপবে। পরের দিন সকাল ৮.২৭ মিনিয়ে সাভারের ২০৪ নম্বর রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায়। ১২ ডিসেম্বর মতিঝিলের বক্স কালভার্টে হাদির সঙ্গে দেখা করা পর উঠে আসে। হাদিও তাঁর গন্তব্যের দিকে যাওয়ার জন্য রিকশায় ওঠে। তারপরেই চলে গুলি।
সাধারণভাবে কোনও অপরাধী অ্যাকশন চালিয়ে সে আত্মগোপন করে। কিন্তু ফয়সাল চলে যায় আগাড়গাঁওয়ে তাঁর বোনের বাড়ি। এখানেই উন্মোচিত হয় এক পারিবারিক অপরাধের চিত্র। সাধারণভাবে ছেলে অপরাধ করলে বাবা-মা তাঁকে শাস্তি দেয়। এ ক্ষেত্রে হয়েছে ঠিক উল্টো। ফয়সালের বাবা এই জঘন্য কাজের জন্য নিজে মাঠে নামেন। ফয়সাল যে বাইকে চেপে হাদিকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিল, সেই বাইকের ভুয়ো নম্বর প্লেট খুলে আসল নম্বর প্লেট লাগিয়ে দেন। নম্বরটি হল DHAKA METRO L A 54-6376, যাতে পুলিশ কোনওভাবেই গাড়িটি ট্রেস করতে না পারে। ফয়সালের স্ত্রী সাহিদাও সামিল। তারা খুনিদের পালিয়ে যেতে টাকা-পয়সা ও লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে সাহায্য করে। এমনকী খুনিরা যাতে সীমান্ত পেরিয়ে নিরাপদস্থানে চলে যেতে পারে, তার জন্য ফয়সলের স্ত্রী, বাবা-মা এবং বোন প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে। তদন্ত জানা গিয়েছে, ঘাতককে ভাড়া করার জন্য যে পরিমাণ সুপারি দেওয়া হয়েছিল, সেই টাকা ফয়সলের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও ভাগ করে দেওয়া হয়। রক্তমাখা টাকার ভাগ ফয়সালের বাবা-মায়ের পকেটেও ঢুকেছে। ছেলের প্রাণ বাঁচাতে তাঁরা প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা চালায়। নরসিন্দির বিলে অস্ত্র ফেলে দেওয়া থেকে শুরু করে কিংবা মেয়ের বাড়িতে থেকে ম্যাগাজিন নীচে ফেলে দেওয়া, অর্থাৎ একজনকে খুনের হাত থেকে বাঁচাতে যা যা করা হয়ে থাকে ফয়সালের বাবা-মা সেই সব কাজগুলো করেছে।
কিন্তু গোয়েন্দাদের চোখ বলে কথা। তারা সন্দেহ করেছিল ফয়সালকে। তাই, তারা সোজা ফয়সালের বাড়ি যায়। সেখানে তারা তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার করে কোটি টাকার একটি চেক। যা প্রমাণ করে এই হামলা কোনও ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে নয়। এটা ছিল বিশাল অংশের লেনদের ফল। আর তার উৎস খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসে এক রাঘব বোয়ালের নাম। তিনি মহম্মদপুরের এক সাবেক কাউন্সিলর। এই কাউন্সিলরই স্থানীয় মাস্টারমাইন্ড। দেশে বসে সমস্ত আর্থিক লেনদেন সামাল দিয়েছেন। কিন্তু এত টাকা খরচ করা হল শুধুমাত্র একজনকে খুন করার জন্য? গোয়েন্দা তদন্তে উঠে এসেছে ভয়ংকর তথ্য। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের এক জনপ্রিয় নেত্রীর সাম্প্রতিক কয়েকটি অডিও ক্লিপ আর এই গুলি এক অদৃশ্য সুতোয় গাঁথা। একটি অডিও তাঁকে বলতে শোনা যায় – কেন তাঁর দলের কর্মীরা মানুষ মারতে পারছে না? তা নিয়ে তিনি বেশ ক্ষোভ ঝাড়ছিলেন। অন্য একটি অডিও ক্লিপে ১১ ডিসেম্বর থেকে ঢাকায় একটি বড়ো ধরনের অপারেশনের কথা বলা হয়। সেখানে স্নাইপার বা দক্ষ শুটার ব্যবহার করার ইঙ্গিত ছিল। ওসমান হাদির ওপর হামলা এবং ওই জননেত্রীর অডিও ক্লিপের মধ্যে একটা অদৃশ্য মিল পাওয়া যাচ্ছে। ফয়সালের বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া টাকা হল গুলি-কাণ্ডের ফুয়েল। এই টাকা হয়তো বাংলাদেশের কোনও একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষপর্যায় থেকে পাঠানো হয়েছে। তারা চেয়েছিল বড়ো কোন নাশকতা ঘটিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে। কবীরকে গ্রেফতার করার পর তাঁর জবানবন্দি সেই কথাই বলছে। মাঠে এখনও একাধিক শুটার গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। কিলিং মিশনের পরের টার্গেট কে, তা নিয়ে চলছে জল্পনা। কোটি টাকার প্রজেক্ট কি শুধু হাদির জন্য ছিল? না কি হাদির মতো বাকি প্রতিবাদীদের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ জন্য এই বিশাল পরিমাণ টাকা বিলি করা হয়েছে।












Discussion about this post