স্বাধীনতা পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধু যখন ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে তুলছিলেন, ঠিক তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল ঘাতক তাঁর ধানমণ্ডির নিজ বাসভবনে তাঁকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। শুধুমাত্র বেঁচে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। সে সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি তাঁদের মাতৃস্নেহে গ্রহণ করেন এবং ভারতে নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছিলেন। হাসিনা ও তাঁর স্বামীর নাম বদলে নতুন নাম রাখা হয়েছিল মি. ও মিসেস মজুমদার। ইন্দিরা গান্ধি দিল্লিতে ড. ওয়াজেদ মিয়ার জন্য একটি গবেষকের চাকরিরও ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ঘটনাক্রমে এবার আক্রান্ত হয়েছিলেন শেখ হাসিনা, প্রেক্ষাপটও প্রায় এক। তবে বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের জন্য প্রাণে বেঁচেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবারও তাঁকে নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছে ভারত, তবে এবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এখন লাখ টাকার প্রশ্ন শেখ হাসিনা কি আবার বাংলাদেশে ফিরতে পারবেন? বিগত দশ মাস তিনি ভারতের আশ্রয়ে রয়েছেন কার্যত আত্মগোপন করেই। তাঁর ঠিকানা কেউ জানে না। তাহলে কোন উপায়ে তিনি নিজের দেশে ফিরবেন?
বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ও তাঁর পুত্র জয়. শেখ রেহানা ও তাঁর কন্যা টিউলিপের নামে একাধিক মামলা দায়ের হয়েছে। পুর্বতন প্রধানমন্ত্রী হাসিনার বিচারও শুরু হয়েছে ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে। এই পরিস্থিতিতে তাঁর দেশে ফেরার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কিন্তু বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি তথা শেথ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ট বলে পরিচিত আব্দুল হামিদ দেশে ফিরলেন, এবং বিনা বাঁধায় ফিরলেন। তিনিও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশ জুড়ে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। অনেক ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। কিন্তু আব্দুল হামিদ ফিরলেন বীরের বেশে, তাঁকে গ্রেফতারও করার সাহস দেখালেন না কেউ। ফলে প্রশ্ন উঠছে, আব্দুল হামিদের মতোই কি শেখ হাসিনাও বীরের বেশে বাংলাদেশে ফিরবেন? ইতিহাসে উদাহরণও আছে, তাঁর রূপকথার প্রত্যাবর্তন নিয়ে।
এবার আসি আব্দুল হামিদ প্রসঙ্গে। গত ৭ মে গভীর রাতে থাইএয়ারে ব্যাঙ্কক চলে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ। তিনি আওয়ামী লীগের আমলে ২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত একটানা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। জুলাই আন্দোলনের সময় কিশোরগঞ্জের একটি খুনের ঘটনায় নাম জড়ায় আব্দুল হামিদের। তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত চলছিল। কিন্তু তিনি চিকিৎসা করানোর জন্য ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ব্যাঙ্কক চলে যান। সে সময় উত্তাল হয়েছিল গোটা বাংলাদেশ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা প্রায় অচল করে দিয়েছিল রাজধানী ঢাকা। দাবি উঠেছিল, যে পুলিশকর্মী, বিমানবন্দরের আধিকারিকরা আব্দুল হামিদকে দেশ ছাড়তে সাহায্য করেছিলেন, তাঁদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। চাপে পড়ে সে সময় বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গির আলম চৌধুরী বুক ঠুকে বলেছিলেন, ‘দায়ী পুলিশের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে না পারলে আমি নিজে পদত্যাগ করব। পাশাপাশি তিনি বলেছিলেন, দরকার পড়লে আব্দুল হামিদকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ধরে আনা হবে।
কিন্তু এক মাসের মধ্যেই চিকিৎসা করিয়ে দেশে ফিরলেন আব্দুল হামিদ। তিনি যেভাবে বিনা বাঁধায় বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন, সে ভাবেই বিনা বাঁধায় বাংলাদেশে প্রবেশ করলেন। কেউ তাঁর কেশাগ্রই স্পর্ষ করতে পারলেন না। আর তাঁর চিকিৎসার জন্য দেশত্যাগ এবং পরে ফিরে আসা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আঙিনায় নতুন এক আলোচনা শুরু হয়েছে। আব্দুল হামিদের দেশত্যাগের পর ঘটনার তদন্তে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যার নেতৃত্বে ছিলেন উপদেষ্টা পরিষদের তিন সদস্য। পাশাপাশি বেশ কয়েকজনকে সাসপেন্ডও করা হয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে। কিন্তু সেই উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি তাঁদের রিপোর্ট পেশ করার আগেই ফিরে এলেন আব্দুল হামিদ। মজার বিষয়. এরপর সেই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাই পাল্টি খেয়ে বললেন, “আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট না থাকায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তদন্ত করার পর যে দোষী প্রমাণিত হবে তাকে আইনের আওতায় নেওয়া হবে।”।
এখানেই প্রশ্ন উঠছে, যাকে নিয়ে এত হইচই, তাঁকে নিয়েই কেন দ্বিমত? ওয়াকিবহাল মহলের মতে, আসলে জাতীয় নাগরিক পার্টি এবং জামাত-সহ ইসলামিক সংগঠনগুলির চাপে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে সমস্ত মামলা দায়ের করে বিচার শুরু করেছে, তার প্রায় সবকটাই ভুয়ো। এর কোনো ভিত্তি নেই। টিউলিপ সিদ্দিক যেমন খোলা চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন, তেমনই আব্দুল হামিদও প্রমান করলেন আসলে যত হম্বিতম্বি সবটাই ফাঁকা। তাই কোনও একদিন শেখ হাসিনাও বুক ফুলিয়ে বীরের বেশে দেশে ফিরবেন। সেদিনও ঠেকাতে পারবে না মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী এই শক্তি। যেমনটা ফিরেছিলেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে।
Discussion about this post