আবালবৃদ্ধবিনিতার মুখে এখন একটাই শব্দ, সেটা হল সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। বাংলাদেশের সঙ্গে বর্তমানে যে গরমাগরম চলছে সেই আবহেই নতুন করে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের দাবি উঠছে। আট বছর আগে, ঠিক এমন একটা পরিস্থিতিতে ভারতীয় সেনা পাকিস্তানের মাটিতে ঢুকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করেছিল। এবার বাংলাদেশের মাটিতে ভারতের জাতীয় পতাকার অবমাননা হচ্ছে, সে দেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর লাগাতার নির্যাতন হচ্ছে, পাশাপাশি বাংলাদেশ এখন জঙ্গিদের মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনই সেখান থেকে ভারতকে হুমকি দেওয়া, ভারত বিদ্বেষী মন্তব্য, উস্কানি চলছে। ফলে বাংলাদেশে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের দাবি উঠছে বিভিন্ন মহলে।
উরিতে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ১০ দিন পরের এক শীতল রাত। দিনটা ছিল ২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ভিতর ঢুকে ভারতীয় সেনার বিশেষ ফোর্স উড়িয়ে দিয়ে এসেছিল বেশ কয়েকটি জঙ্গি ঘাঁটি। রাত ১২টায় শুরু হওয়া ওই অপারেশন শেষ হয়েছিল ভোর ৪টায়। অর্থাৎ মাত্র ৪ ঘন্টার নিখুঁত অপারেশন, যাতে নিহত হয়েছিল ৩৫ থেকে ৭০ জন জঙ্গি। পরে পাকিস্তান অবশ্য দাবি করেছিল তাদের ২ সেনা নিহত এবং ৯ জন আহত হয়েছেন। কিন্তু ভারতের কোনও সেনা আহত পর্যন্ত হয়নি ওই বিশেষ অপারেশনে। পাকিস্তানের ভিতর ঢুকে তাঁদেরই মদতে চলা জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করার এই ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পেয়েছে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ নামে। যা নিয়ে আজও বিশ্ব রাজনীতিতে চর্চা হয়। ভারতীয় সেনার করা প্রথম সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এতটাই নিখুঁত ও পরিকল্পিত ছিল যে বিশ্বের অন্যান্য দেশও ধন্য ধন্য করেছে। সেই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের আট বছর পর ফের নতুন করে চর্চায় এসেছে। তবে এবার উপলক্ষ্য বাংলাদেশ। ভারত কী ফের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রস্তুতি নিচ্ছে? আর সেটা হলেও কেন ও কোথায় হতে পারে? এটাই এখন সোশ্যাল মিডিয়ার চর্চার বিষয়।
২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাতের অন্ধকারে পাক মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদীরা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরের উরিতে অবস্থিত ভারতীয় সেনা ঘাঁটিতে ঢুকে পড়েছিল। তাঁরা সেনা চাউনিতে ঢুকে ঘুমন্ত জওয়ানদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। সেখানে শহীদ হন ভারতের ১৯ জন জওয়ান। এই ঘটনার দায় নিয়েছিল পাক জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মহম্মদ। উড়ি হামলার পরদিনই ভারতীয় সেনাবাহিনী জানিয়ে দিয়েছিল, এই হামলার জবাব নির্দিষ্ট সময় এবং স্থানে দেওয়া হবে। সেদিন থেকেই হয়তো পাকিস্তানের মাটিতে ঢুকে হামলার ছক কষা শুরু হয়েছিল ভারতীয় সেনার। এবার জানার চেষ্টা করি, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক আসলে কি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ কোনও যুদ্ধ নয়। এমনকী, কোনও ছায়া-যুদ্ধও নয়। সামরিক দিক থেকে এর অর্থ হল, খুব অল্প সময়ে, অত্যন্ত দ্রুত গতিতে শত্রুদের গোপন ডেরা বা সুড়ঙ্গ বা কোনও দুর্গম, দুর্ভেদ্য ঘাঁটির ওপরে চালানো গোপন অভিযান। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়ে শত্রুদের ঘাঁটিগুলিকে গুঁড়িয়ে-উড়িয়ে দিয়ে আসার পর সেনাবাহিনী আর সেই এলাকায় মোতায়েন থাকে না বা সেই এলাকা দখল করে বসে থাকে না। হানাদারির উদ্দেশ্য সফল হলেই সেনাবাহিনীর জওয়ান বা কমান্ডোরা আবার দেশে বা তার আগের অবস্থানে ফিরে আসেন। ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালিয়ে সেনাবাহিনী শত্রুদের আটক বা গ্রেফতার করে না। তাদের একেবারে নিকেশ করে দেয়। সম্পুর্ণ অভিযান চালানো হয় অত্যন্ত গোপনে এবং আলোর গতিতে। ফলে এতে যারা হানা দিচ্ছে, তাঁদের ক্ষয়ক্ষতি বা হতাহতের পরিমান হয় না বললেই চলে। যেমন, উড়ির ঘটনার পর পাকিস্তানের মাটিতে চালানো ৪ ঘণ্টার সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে ভারতের কেউ হতাহত হননি।
সার্জিক্যাল স্ট্রাইক সকলকে জানিয়ে হয় না। সেনাবাহিনীর গুটিকয় শীর্ষকর্তা এবং সরকারের শীর্ষমন্ত্রিদের সমন্বয়ে এই সিদ্ধান্ত হয়। এবং অত্যন্ত দ্রুত তা পালন করা হয়। একটাই নিশানা, তাও নিখুদভাবে নির্ভুল হতে হবে। অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্তাদের কথায়, কোনও সার্জেন যেমন তাঁর সার্জারির সময় নিখুঁতভাবে ছুঁড়ি-কাঁচি চালিয়ে অস্ত্রোপচার করেন, ঠিক সেরকমই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সময় সেনা কমান্ডোদের অনেকটা অর্জুনের মতো মাছের চোখে তির মারতে হয়। ভারত পাকিস্তানে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করলেও, আদৌ বাংলাদেশে এমন কোনও অভিযান করবে কিনা সেটা এখনই বলা সম্ভব নয়। কারণ, বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
Discussion about this post