ব্যাংককে মোদি-ইউনূস বৈঠকের পরই বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম অনেক বড় বড় দাবি করেছিলেন। অথচ ভারতের কয়েকটি দাবির মধ্যে অন্যতম ছিল বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ যেন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মুখ বন্ধ রাখে, এতে দুদেশের সম্পর্কে ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু ভারতের কথায় কান দেয়নি বাংলাদেশ। ফলে ওই বৈঠকের পাঁচ দিনের মাথায় ভারত সরকার একটা কড়া সিদ্ধান্ত নিল। বাংলাদেশকে দেওয়া ভারতের বন্দরগুলি ব্যবহারের ট্রান্সক্রিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে দিল ভারত। তাতেই বেজায় সমস্যায় পড়েছে বাংলাদেশের তদারকি সরকার। তড়িঘড়ি বৈঠকে বসে পরিস্থিতি মোকাবিলা রূপরেখা তৈরি করতে দেখা গেল সে দেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনকে। পরে তিনি বলেন, ভারত সরকার বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের পর পোশাক রফতানি স্বাভাবিক রাখতে ঢাকা ও সিলেট বিমানবন্দর ব্যবহার করা হবে। তিনি আরও জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সরকার তৈরি পোশাক রফতানি-সহ সার্বিক বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। ঢাকা ও সিলেট বিমাণবন্দরের নিজস্ব সক্ষমতা ব্যবহার করে এ প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখা হবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ঢাকা বা সিলেট বিমানবন্দরের সক্ষমতা যদি বেশিই থাকতো তাহলে বাংলাদেশী রফতানিকারকরা কেন ভারতের কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহারের দিকে বেশি ঝুঁকেছিলেন? এর পিছনে রয়েছে অনেকগুলি কারণ। প্রথমত, ঢাকা বিমানবন্দর থেকে যেকোনও পণ্যের রফতানি খরচ অনেকটাই বেশি। কারণ বিমান সংস্থাগুলির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই, ফলে তারা ইচ্ছামত মূল্য নির্ধারণ করে থাকে, আবার চাপ বাড়লে ভাড়াও বাড়িয়ে দেন। যেটা ভারতে হয় না। ঢাকা বা যশোর বা রাজশাহী থেকে কলকাতার দূরত্ব খুবই সামান্য, তাই ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধা ব্যবহার করে বাংলাদেশি রফতানি সংস্থাগুলো খুব সহজেই স্থলবন্দর ব্যবহার করে কলকাতায় তাদের পণ্য পাঠিয়ে দেয়। দ্বিতীয়তঃ ঢাকা বা সিলেট থেকে মধ্যপ্রাচ্য বা পশ্চিমী দেশগুলির মধ্যে বিমান যোগাযোগ অনেক কম। যা কলকাতা বিমানবন্দরের আছে। ফলে খুব অল্প সময়ে দ্রুততার সঙ্গে পোশাক বা অন্যান্য পণ্য বিদেশে চালান করা সম্ভব হয়। বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের দাবি অনুযায়ী, এবার তারা ঢাকা বা সিলেট বিমানবন্দরের পরিকাঠামো বৃদ্ধি করবেন, যা সময় সাপেক্ষ। এখানেই শেষ নয় বিভিন্ন এয়ারলাইন্স সংস্থাগুলির সঙ্গে আলোচনা করে শুল্ক নির্ধারণ করাটাও এখন কঠিন একটা কাজ। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে এই সময় ব্যবহার করেই ভারতীয় রেডিমেড পোশাক শিল্প বিশ্ব বাজারে অনেকটাই জায়গা দখল করে নেবে। আসলে এটাই বাংলাদেশের মাথা ব্যথার কারণ।
বাংলাদেশের তদারকি সরকার মুখে যাই বলুক না কেন, ভারতের এই সিদ্ধান্তে তাঁরা যথেষ্টই চাপে পড়েছে। গত মঙ্গলবার ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশের পণ্য তৃতীয় দেশে যাওয়ার সুবিধা বাতিল করার ঘোষণা আসতেই কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। পরদিন অর্থাৎ বুধবার ভারতের বিদেশমন্ত্রক জানিয়ে দেয়, নেপাল ও ভুটান ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা পাবে। বাকি কোনও দেশে আর ভারতের ভুখন্ড ও বন্দর ব্যবহার করতে পারবে না বাংলাদেশ। সেদিন রাতেই তড়িঘড়ি একটি জরুরি বৈঠকে বসেন বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তারা, উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সেখ বশিরউদ্দিন। বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে একটি আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়। সেখানে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নেওয়া হয়। যদিও কোন পথে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হবে তা এখনো ঠিক করতে পারেনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে মুখ খোলেননি প্রধান উপদেষ্টা বা তার প্রেষ সচিব। কিন্তু বাংলাদেশের রফতানিকারক সংস্থাগুলির দাবি, ভারতের এই সিদ্ধান্তে তারা প্রবল ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ইতিমধ্যেই বেনে ফল সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের চারটি রফতানি পণ্য বোঝাই ট্রাক ফেরত পাঠিয়েছে ভারত। ফলে দ্রুত সেই চালান ক্রেতা দেশে পাঠানো এখন অনেক বড় চ্যালেঞ্জ তাদের সামনে। ঢাকা বা সিলেট বিমানবন্দরের সক্ষমতা কবে বৃদ্ধি পাবে সেটা নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। আপাতত “ওনলি গার্ডিয়ান অফ দ্য ওসেন” বাংলাদেশের বিশ্ব বাণিজ্য অথৈ জলে পড়েছে।
Discussion about this post