গত ১২ সেপ্টেম্বর নবান্ন সভাঘরে আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠক ভেস্তে গিয়েছিল লাইভ স্ট্রিমিং করা নিয়ে। সেই দিন মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি বিচারাধিন, তাই লাইভ স্ট্রিমিং করা যায় না। এর পর গঙ্গা দিয়ে অনেকটাই জল গড়িয়েছে, জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলন আমরণ অনশন পর্যন্ত গড়িয়েছে। ফলে রাজ্য সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরও চাপে পড়েছেন। এই আবহেই জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি না থাকলেও এক মাস ৯ দিনের মাথায় মুখ্যমন্ত্রী সেই বৈঠকেরই লাইভ স্ট্রিমিং করলেন সকলকে চমকে দিয়ে। ফলে অভাবনীয় ঘটনা ঘটল ২১ অক্টোবর, সোমবার। বৈঠকে ১০ জন জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি দলের নবান্নে যাওয়ার কথা থাকলেও গেলেন ২২ জন। তাদের মধ্যে ১৭ জন যোগ দিলেন সরাসরি বৈঠকে। সেটাও মেনে নিল রাজ্য সরকার।
যে লাইভ স্ট্রিমিং বা সরাসরি সম্প্রচার করা নিয়ে এতদিন টানাপোড়েন চলছিল, এবার তাতেই শিলমোহর দিলেন মুখ্যমন্ত্রী, তাও আবার নিজের করা যুক্তি নিজেই খণ্ডন করে। প্রথমে ১২ সেপ্টেম্বর নবান্ন, তারপর ১৪ সেপ্টেম্বর কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি, দুটি ক্ষেত্রেই জুনিয়র ডাক্তারদের লাইভ স্ট্রিমিংয়ের দাবি সরাসরি খারিজ করেছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু কি এমন ঘটল ২১ অক্টোবর, যে না চাইতেই রাজ্য সরকার জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক সরাসরি সম্প্রচার করে দিল। যা নিয়ে কৌতুহল তৈরি হয়েছে জনমানসে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এটা নিয়ে তুমুল জল্পনা-কল্পনা চলছে।
প্রথমদিকে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, যে হেতু মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধিন, তাই সরকার চাইলেও সরাসরি সম্প্রচার করতে পারে না। জুনিয়র ডাক্তার এবং নাগরিক সমাজের একটা অংশের বক্তব্য ছিল সুপ্রিম কোর্ট নিজেই যেখানে প্রতিটি শুনানি সরাসরি সম্প্রচার করছে, সেখানে এই বৈঠকের ক্ষেত্রে কেন হবে না? কিন্তু রাজ্য সরকার অনঢ় ছিল নিজেদের সিদ্ধান্তে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, লাইভ স্ট্রিমিং না হলেও ভিডিও ক্যামেরায় পুরো বৈঠক ধরে রাখা হবে। কিন্তু জুনিয়র ডাক্তারদের ভিডিওগ্রাফারদের প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠল। পরবর্তী সময় কালীঘাটে বৈঠক হলেও বৈঠকের বিবরণী লিপিবদ্ধ করা নিয়ে জটিলতা হয়। সবমিলিয়ে তীব্র জটিলতার সৃষ্টি হয় এই লাইভ স্ট্রিমিং নিয়ে। যদিও স্বাস্থ্যভবনের সামনে ধর্নার ৭ দিনের মাথায় লাইভ স্ট্রিমিং ছাড়াই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসকরা। বোঝাই গিয়েছিল, এই দাবি থেকে অনেকটাই সরে এসেছিল আন্দোলনকারীরা। তাই এবার নবান্নের বৈঠকে সেই দাবিও করেননি জুনিয়র ডাক্তাররা। কিন্তু সকলকে অবাক করে রাজ্য সরকার সরাসরি সম্প্রচার করে দেয় এই বৈঠকের।
সোমবারের বৈঠকে জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধিরা নিজের বক্তব্য রাখলেন এক এক করে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নিজের বক্তব্য রাখেন। জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি দলের হয়ে অনিকেত মাহাত মেডিকেল কলেজগুলিতে চলা থ্রেট কালাচার নিয়ে বিস্তারিত বলেন। এরপর আরেক প্রতিনিধি দাবি তোলেন রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিবের অপসারণের। সেই সময়ই দেখা যায় মুখ্যমন্ত্রীও জুনিয়র ডাক্তারদের এই দাবি খণ্ডন করছেন। অপরদিকে তাঁরাও নিজেদের যুক্তি সাজিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে বুঝিয়ে দিলেন স্বাস্থ্যসচিবকে অভিযুক্ত বলাই যায়। আবার আর জি কর মেডিকেল কলেজ বা মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজে যে কয়েকজন পড়ুয়া চিকিৎসককে সাসপেন্ড করা হয়েছিল তা নিয়েও বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায় জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীকে।
সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, মুখ্যমন্ত্রী এই কারণেই লাইভ স্ট্রিমিংয়ে আপত্তি তুলছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, জুনিয়র ডাক্তাররা সহজে ছেড়ে দেবে না। তাঁরা আকুতভয়, দীর্ঘ তিনমাস ধরে তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। কোনও চাপের কাছেই মাথা নত করেননি। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকেও তাঁরা যে সহজে সবকিছু মেনে নেবেন না সেটাও বুঝেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। আর সেই জন্যই তিনি লাইভ স্ট্রিমিংয়ে আপত্তি ছিল বলে মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল। তবে এবার পরিস্থিতিটা আলাদা। জুনিয়র ডাক্তারদের অনশন দুই সপ্তাহ অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁদের হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছিল। ফলে বড় ধরণের কোনও বিপদের আগেই মুখ্যমন্ত্রী নমনীয় মনোভাব নিলেন বলে মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল।
Discussion about this post