“ঠাকুর ঘরে কে? আমি তো কলা খাইনি”। বাংলার অতি প্রাচীন প্রবাদ। বাংলা বাগধারায় এই প্রবাদটি কেন ব্যবহার হয়, সেটা আমরা কমবেশি সকলেই জানি। সম্প্রতি আর জি কর কাণ্ড নিয়ে রাজ্যের শাসকদলের নেতাদের বক্তব্য শুনে বাংলার এই প্রাচীন প্রবাদের কথাই মনে হচ্ছে। বিশেষ করে তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষের বক্তব্য বা তৃণমূল নেত্রীর মন্তব্য থেকে। আর জি কর কাণ্ডের বিচার চেয়ে আজ পথে নামছে নাগরিক সমাজ। কোনও রাজনৈতিক দলের ব্যানার সাইডে রেখে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি নিজের মতো করে প্রতিবাদ কর্মসূচি নিচ্ছে। আবার রাজ্যের চিকিৎসক মহল ফুঁসছে। সবাই বিচার চাইছেন। মজার বিষয়, রাজ্যের শাসকদলও ‘বিচার’ চাইছে। কিন্তু তার পরও সাধারণ মানুষ, বিরোধীদের বিচারের দাবিকে নস্যাৎ করে রোজই সুর চড়াচ্ছে তৃণমূল। ঠিক অনেকটা “ঠাকুর ঘরে কে? আমি তো কলা খাইনি” গোছের ব্যাপার।
আজকের আধুনিক সভ্যতায় হাতে লেখা চিঠির গুরুত্ব নেই বললেই চলে। সেই জায়গা দখল করেছে ই-মেল। কেউ কাউকে ই-মেল করলে চোখের পলকে তা পৌঁছে যায় প্রাপকের কাছে। তিনিও জবাব দিলে সেও পৌঁছে যায় নিমেষে। আবার এখন ভাইরাল যুগ, যদি কোনও বিতর্কিত বিষয়ে ইমেল চালাচালি হয়, তা জনসমক্ষে আসতে সময় লাগে না। এই যেমন জুনিয়র ডাক্তার এবং রাজ্য সরকারের মধ্যে চিঠি-চাপাটির পালা চলছিল। তাও সমাজ মাধ্যমে অবাধে ঘুরে বেরাচ্ছে। আজকের গল্প সেটা নিয়ে নয়, বরং আজকের আলোচনা “চেয়ার” নিয়ে।
আর জি কর হাসপাতালে এক তরুণী চিকিৎসক পড়ুয়াকে কে বা ধর্ষণ করে খুন করেছে তা এখনও পরিষ্কার নয়। প্রায় একমাস হতে চলল সিবিআই তদন্ত চলছে, কিন্তু এখনও প্রকৃত ঘটনা সামনে আসেনি। আর অন্যদিকে আর জি কর হাসপাতাল-সহ রাজ্যের সমস্ত মেডিকেল কলেজে জুনিয়র ডাক্তাররা কর্ম বিরতি করছেন কয়েকটি দাবি দাওয়া নিয়ে। এরমধ্যে প্রথমেই রয়েছে আর জি করের ওই নির্যাতিতার বিচারের দাবি। এছাড়া নিরাপত্তা ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের দাবিও রয়েছে। এমন একটা গুরুতর বিষয়ে রাজ্য সরকারের যা ভূমিকা থাকা দরকার তা কী আদৌ দেখা যাচ্ছে? বিশেষ করে বৃহস্পতিবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পর তা আরও বড় আকারে সামনে আসছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, আলোচনা ভেস্তে গিয়েছে জুনিয়র ডাক্তারদের অনমনীয় মনোভাবের জন্য। তিনি তিনদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলেন এই আলোচনার জন্য। এমনকি বৃহস্পতিবারও তিনি দুই ঘণ্টার বেশি অপেক্ষা করেন। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে দু-তিনজনের জন্যই এই আলোচনা ভেস্তে গিয়েছে। কারণ পিছন থেকে রাজনীতির ইন্ধন রয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী সুকৌশলে বিষয়টি রাজনীতির আঙ্গিনায় টেনে নিয়ে এলেন। তাঁর দাবি, জুনিয়র ডাক্তারদের এই আন্দোলনে রাজনৈতিক রঙ রয়েছে। এমনকি তিনি এও দাবি করেছেন, জুনিয়র ডাক্তাররা বিচার চায় না, ওরা চেয়ার চায়। রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহলের অভিমত, নবান্নে জুনিয়র ডাক্তাররা যে মূল দাবিটি করেছিলেন সেটাতেই চাপে পড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বৈঠকের লাইভ স্ট্রিমিং বা সরাসরি সম্প্রচার হলে অনেকটাই অস্বস্তিতে পড়তে হতো রাজ্য প্রশাসনকে, এবং অবশ্যই মুখ্যমন্ত্রীকে। তাই ডাক্তারদের সেই দাবি মেনে নিতে পারেননি মুখ্যমন্ত্রী। সেই দিক থেকে ঘটনার দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরাতেই তিনি চেয়ারের প্রসঙ্গ টেনে আনলেন। যদিও আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের বক্তব্য, তাঁরা বিচার চাইতেই গিয়েছিলেন, চেয়ারের প্রত্যাশা তাঁদের নেই। এছাড়া তাঁরা কখনওই মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি করেননি। অভিজ্ঞমহলের বক্তব্য, আসলে জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফেরাতে কার্যত ব্যর্থ রাজ্য প্রশাসন। সেই ব্যর্থতা ঢাকতেই অনেকটা ‘ঠাকুর ঘরে কে, আমি তো কলা খাইনি’ গোছের জবাবে উঠে আসল চেয়ার প্রসঙ্গ।
Discussion about this post