আপাতত এক মাস স্থগিত হকার উচ্ছেদ। মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই পিছু হটলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু কেন? রাজনীতিবিদদের একাংশ মনে করছেন ব্যালটে ভারসাম্য ধরে রাখতেই মমতার এই নতুন সিদ্ধান্ত। সোমবার একযোগে প্রশাসন, দলের নেতা, কাউন্সিলরদের নিশানা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের নগর ও মহানগরের রাস্তায় হকারদের বাড়বাড়ন্ত ছিল নেত্রীর অসন্তোষের মূল কারণ। ফুটপাথ দখল, সরকারি জমি দখল। সবটাই উঠে এসেছিল মমতার কথায়। সবাইকে চমকে দিয়ে নেত্রী দায় চাপিয়ে ছিলেন তাঁর সরকারের আমলা, প্রশাসনের ঘাড়ে। বাদ যাননি দলীয় কাউন্সিলররাও। পুলিশ, নেতা ও কাউন্সিলরদের যোগসাজশে এমনটা ঘটছে বলে প্রকাশ্যে ধমকের সুরে বলেছিলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি শোনার পরপরই রাস্তায় নেমেছিল প্রশাসন। রোবটের গতিতে ভাঙা পড়েছে ফুটপাথের ধারে বসে পড়া স্থায়ী, অস্থায়ী স্টল। রাতারাতি কাজ হারিয়েছেন বহু মানুষ।
বঙ্গ রাজনীতির অলিন্দে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, কেন এমন হঠকারি সিদ্ধান্ত? কেন সময় বেধে দেওয়া হল না ফুটপাথবাসীদের। যিনি একসময় রেলেমন্ত্রী থাকাকালীন রেলে হকার উচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন, বাম আমলে অপারেশন সানসাইনের বিরোধিতা করে ছিলেন। আজ তাঁরই নির্দেশে রুটি রুজি হারাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। এ প্রসঙ্গে ওয়াকিবহাল মহলের ব্যাখ্যা, ফুটপাথের ধারে ব্যাঙের ছাতার মতো যেমন দোকান ঘর গজিয়েছে এর দায় শুধু তাদের নয় যারা ব্যবসা পেতে বসেছেন। এই দায় তাঁদেরও যারা এতদিন দেখেও না দেখে থেকেছেন। সেই দায় কি কোনভাবে এড়াতে পারে পুলিশ-প্রশাসন। অথবা স্থানীয় কাউন্সিলর, নেতা, বিধায়করা। এইসব প্রশ্ন যখন উঠছে তখন বৃহস্পতিবারও একটি প্রশাসনিক বৈঠক সারেন মমতা। বৈঠক শেষে সাংবাদিক বৈঠক করে তিনি জানিয়ে দেন আপাতত একমাস স্থগিত থাকবে হকার উচ্ছেদ। এখন প্রশ্ন উঠছে মুখ্যমন্ত্রী এমন সিদ্ধান্ত হঠকারীভাবে নিতে গেলেনই বা কেন? পিছিয়েই বা আসলেন কেন?
রাজনৈতিক মহলের বিশ্লেষণ,
প্রথমত– লোকসভা ভোটে শহরের ব্যালটে তৃণমূল থেকে মুখ ফিরিয়েছে সাধারণ মানুষ। রাজ্যজুড়ে ১২১ টি পুরসভার মধ্যে ৬৯ টি পুরসভায় পিছিয়ে রয়েছে তৃণমূল। আর তাতেই টনক নড়েছে মুখ্যমন্ত্রীর। যিনি ঘাসফুলের প্রতিনিধি বলে পরিচিত আজ তিনিই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের পাশ থেকে। রাজনৈতিকবিদদের একাংশ মনে করছেন সদ্য সমাপ্ত অষ্টাদশ লোকসভা ভোটে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা নজরে এসেছে তৃণমূলের। তাই ভোট মিটতেই তারা সতর্ক। তারই ফলশ্রুতি হিসেবে শহরবাসীর কথা ভেবে হকার উচ্ছেদের তোড়জোড়।
দ্বিতীয়ত– ফুটপাথ দখলের মত বিষয়টি গত বিধানসভা নির্বাচনের সময়েও ছিল। তখন তো ভোটে প্রভাব পড়েনি। এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। তাই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ক্ষেত্রে শুধু হকারদের দোষালে হবে না তৃণমূল নেতার বাড়ি থেকে টাকা উদ্ধার, নিয়োগ দুর্নীতি, রেশন দুর্নীতির মত বিষয়গুলিও রয়েছে।
তৃতীয়ত– শহরের লোক মুখ ফেরালেও গ্রামগঞ্জের ভোট রয়েছে তৃণমূলের পাশেই। হকারদের অনেকেই গ্রাম থেকে এসে শহরে ব্যবসা করছেন। সুতরাং তাঁদের পেটে লাথি মারা মানেই আদতে ভোটের ব্যালটে কিছুটা হলেও পিছিয়ে পড়া।
চতুর্থত – মুখ্যমন্ত্রী নিজের অবস্থানে অনড়, তা বোঝাতে গিয়ে রাস্তা দখলে যে সব দলীয় নেতাদের যোগসাজশ রয়েছে তাঁরাও পাড় পাবেন না বলে জানিয়েছেন। এমন কি কোন এলাকা দখল হলে কাউন্সিলরকে গ্রেফতার করা হবে। হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন। শাসক শিবিরের একাংশের বক্তব্য, ওই ঘোষণা মারফত তিনি এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন যে, তিনি প্রশাসনের থেকে দলকে বিচ্ছিন্ন করে দেখছেন। যাতে দলের ‘দায়’ সরকারের উপর এসে না-পড়ে।
পঞ্চমত– ফুটপাথ থেকে হকার উচ্ছেদে আরেকটি বিষয় তিনি বার বার উল্লেখ করেছেন। বাংলার আইডেন্টিটি নষ্ট হওয়া। ফুটপাথবাসীদের মধ্যে অনেকেই হিন্দি বেল্টের। এদের অধিকাংশই বিজেপির সমর্থক। কাজেই হকার উচ্ছেদ হলে ভোটবাক্সে বড় প্রভাব পড়বে না।
তবে এগিয়ে গিয়েও পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি ভালোভাবে নাও নিতে পারে রাজ্যবাসী। তারজন্যই সরকারের ‘সদিচ্ছা’ প্রমাণে অভিযান বাতিলের কথা ঘোষণা করেননি মমতা। তিনি বলেছেন, আপাতত এক মাস এই উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ থাকবে। গড়ে দিয়েছেন পাঁচ সদস্যের একটিহকার কমিটি। এক মাস পরে তিনি আবার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করবেন। প্রসঙ্গত, প্রশাসনের অনেকেই মনে করেন, কোনও বিষয়কে সাময়িক ভাবে ‘ধামাচাপা’ দেওয়ার প্রকৃষ্টতম উপায় হল একটি কমিটি গড়ে দেওয়া। এখন দেখার, এক মাস পরে ওই কমিটি কী রিপোর্ট দেয় এবং সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে মমতা কী সিদ্ধান্ত নেন।
Discussion about this post