বাংলাদেশ থেকে মলদ্বীপ, পাকিস্তান থেকে চিন, বিগত কয়েক বছরে ভারতকে তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। বিশেষ করে সদ্য শেষ হওয়া ২০২৪ সালেই ভারত নেপাল, মলদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা ও চিনকে নিয়ে প্রবল অস্বস্তিতে কাটিয়েছে, বা এখনও অসস্তিতে ভুগছে। বলা ভালো ভারতের সঙ্গে তাঁর নিকট প্রতিবেশী দেশগুলির সম্পর্ক চাপানউতোরের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। যা মোটেও কাম্য ছিল না। অথচ নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে প্রথমবারের জন্য ক্ষমতায় এসে প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতি করার জন্য বেশ ঘটা করেই “নেইবারহুড ফার্স্ট” নীতি গ্রহন করেছিলেন। এবং সেবার তাঁর শপথ গ্রহন অনুষ্ঠানে প্রায় সব প্রতিবেশী দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এর পরের কয়েক বছরে নরেন্দ্র মোদি প্রায় সব প্রতিবেশী দেশে ভ্রমণ করেন এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নতি সাধনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের চুক্তি সম্পন্ন করে এসেছিলেন। এটাই ছিল মোদির “নেইবারহুড ফার্স্ট” নীতি বা প্রতিবেশীই প্রথম নীতি। আর্থাৎ নরেন্দ্র মোদি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, ভারতের বিদেশনীতিতে প্রতিবেশী দেশগুলোকেই সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে।
মোদির আমলে মূলত, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, মলদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিবেশী দেশকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। সেখানে বাদ গিয়েছিল পাকিস্তান ও চিন। এর কারনও রয়েছে। পাকিস্তান বরাবরই জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে পা বাড়িয়ে ঝগড়া করে এবং জঙ্গি অনুপ্রবেশ করানোর দিকে মনোনিবেশ করে বলে অভিযোগ। অপরদিকে, চিনও সীমান্তে তাঁদের আধিপত্য বিস্তার করতে উদ্যোগী ছিল। অরুণাচল প্রদেশ, লাদাখের বহু অংশ চিন তাঁদের অংশ বলে দাবি করে এবং তা নিয়ে ভারতের সঙ্গে বিবাদও চলছিল। যাইহোক, ভারত বাকি প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে বধ্যপরিকর ছিল। এখন দশ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, ভারতের প্রতিবেশীই প্রথম নীতি কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। বরং পশ্চিমা দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে। কেন এমনটা হল, তা নিয়ে দীর্ঘ তর্ক-বিতর্ক হতে পারে। যদিও কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এবং মোদি মন্ত্রিসভার সদস্যরা এটাকে খুব একটা পাত্তা দিতে নারাজ।
আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের একটা অংশ দাবি করেন, ভারত মুখে যতই “নেইবারহুড ফার্স্ট” নীতির কথা বলুক, কাজে তা দেখা যায়নি। কারণ, মোদি তথা ভারতের কাছে বরাবরই আমেরিকা, রাশিয়ার মতো দূরের বন্ধুরাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। আবার চিনকে নিয়ে বেশরভাগ সময় মাথা ঘামাতে হয়েছে। যাইহোক, ২০১৪ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েই নরেন্দ্র মোদি নেপাল সফরে যান। পরের বছরই তিনি শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ সফর করেন। এই তিন দেশেই তিনি বিশাল মানুষের থেকে বিপুল অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন। ভারতও এই সমস্ত দেশে বিপুল বিনিয়োগ করে সে দেশের পরিকাঠামো উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনের জন্য। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির এই প্রয়াস খুব একটা কার্যকর হয়নি বলেই মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল। কারণ ভারতের “নেইবারহুড ফার্স্ট” নীতির এক দশকের মধ্যেই ছবিটা আমূল বদলে যায়। ভারত যে শ্রীলঙ্কাকে চরম আর্থিক সংকটের সময় বিপুল সাহায্য করেছিল, সেই শ্রীলঙ্কাই দিল্লির ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে চিনের দিকে ঝুঁকেছিল। নেপালে নতুন সংবিধান প্রণয়নের সময় ভারত সে দেশে অর্থনৈতিক অবরোধের নীতি নেয়। কিন্তু ভারতের প্রচ্ছন্ন হুমকি উপেক্ষা করে নেপাল তাঁদের নীতি প্রণোয়ন করে। এমনকি নেপালের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি কট্টর ভারত বিরোধী বলেই পরিচিত। যে ভূটান সামরিক, বৈদশিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারতের উপর নির্ভরশীল, সেই ভূটানও ভারতকে উপেক্ষা করে চিনের সঙ্গে আলাদাভাবে সীমান্ত আলোচনা চালিয়েছে এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করেছিল।
মলদ্বীপে ভারত বিপুল বিনিয়োগ করেছিল। এমনকি নানান সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাজেও ভারত মলদ্বীপকে সাহায্য করে গিয়েছে। ফলে দীর্ঘসময় মলদ্বীপে ভারত বন্ধু সরকার ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময় ওই দ্বীপরাষ্ট্রে ভারত বিরোধী হাওয়া ওঠে এবং যার জেরে ভারত বন্ধু সরকারকে হঠিয়ে ক্ষমতায় আসে চিনপন্থী মহম্মদ মইজ্জু। তিনি কোনও রাখঢাক না রেখেই ইন্ডিয়া আউট প্রচার করেছিলেন। ক্ষমতায় এসেও তিনি মলদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা সরানোর জন্য চাপ দেন। সব শেষে আসা যাক বাংলাদেশের দিকে। বিগত দেড় দশক বাংলাদেশে শেখ হাসিনার আমলে ভারত নিরাপদ অবস্থানে ছিল। কিন্তু গত আগস্টে শেখ হাসিনার পতন এবং মুহাম্মদ ইউনূসের তদারকি সরকারের গঠন ভারতের পূর্ব পারের প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক একেবারেই তলানিতে এসে ঠেকেছে। এখন বাংলাদেশ ভারতের পরম মিত্র দেশ নয়, বরং শত্রু ভাবাপন্ন বলেই মনে করে। বাংলাদেশে এথন ভারত বিরোধী হাওয়া চলছে এবং পাকিস্তান তাঁদের নতুন বন্ধু হয়েছে। সবমিলিয়ে যদি দেখা যায়, ভারতের প্রতিবেশীই প্রথম নীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে।
কিন্তু আদৌ কি তা হয়েছে?
কূটনৈতিক মহলের একাংশ বলছে, নরেন্দ্র মোদির ভারত একই সঙ্গে “নেইবারহুড ফার্স্ট” নীতি এবং পশ্চিমী দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক সুচারুভাবে ব্যালেন্স করেছে। আর এরই সুফল পেয়েছে বিপদের সময় এসে। যেমন মিয়ানমারে প্রবল গৃহযুদ্ধের সময়ও সে দেশে ভারতের প্রকল্পগুলিতে কোনও আঁচ এসে পড়েনি। বরং আরাকান আর্মি বাংলাদেশ সীমান্তে আধিপত্য বিস্তার করায় ভারতের কিছুটা সুবিধা হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর নিয়ে ভারতকে চাপে ফেললেও মিয়ানমারের কালাদান বন্দরের জন্য খুব একটা সমস্যায় পড়ছে না ভারত। ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় ভারতকে আবার সুবিধাজনক অবস্থায় নিয়ে এল চিনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে। কারণ মোদি সফলভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থীদের সাহায্য করে গিয়েছেন। যার ফসল এবার তুলবে ভারত। চিন এখন অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা কোনঠাসা। ফলে লাদাখ ও অরুণাচল প্রদেশ সীমান্তে পিছু হঠছে চিন। আবার বাংলাদেশ যতই মুখে বড় বড় কথা বলুক, “নেইবারহুড ফার্স্ট” নীতির জেরে এখনও বাংলাদেশকে চাল, আলুর মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপন্য সরবরাহ করে চলেছে ভারত। যা বিশ্ব মঞ্চে বাংলাদেশকে চাপে রাথতে সাহায্য করবে। অপরদিকে আফগানিস্তানের তালিবান সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং আফগানিস্তানে ভারতের বিপুল সাহায্য পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াইয়ে অনেকটাই সাহায্য করেছে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
Discussion about this post