শেখ হাসিনার বিদায়ের পর বাংলাদেশে ক্ষমতায় এসেছে মুহম্মদ ইউনুস সরকার। যার পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে ঠেকতে ঠেকতে একেবারে শেষের দিকে চলে এসেছে। যদিও এই সময়েই আমরা দেখলাম ব্যাংককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে মোদি এবং ইউনূসের একটি পার্শ্ববৈঠক হল। কিন্তু তাতেও কি কমল এই শীতলতা? উত্তর হল না কমেনি। বরং আরও বেড়েছে দুই পড়শি দেশের মধ্যে সম্পর্কের শীতলতা। এরমধ্যেই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ এস জয়শঙ্কর বাংলাদেশকে দিলেন এক স্পষ্ট বার্তা। নয়া দিল্লিতে এক টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে এসে তিনি বললেন, “বাংলাদেশের ভালো ভারতের থেকে বেশি কোনও দেশ ভাবে না এবং এটা ভারতের ডিএনএ-তে আছে”। যা নিয়ে বাংলাদেশজুড়ে চলছে জোরদার জল্পনা-কল্পনা। আসলেই জয়শঙ্কর ঠিক কি বলতে চাইলেন, সেটা নিয়েই চলছে কাটাছেঁড়া।
শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে পদ্মাপাড়ে ক্রমাগত হিন্দু সংখ্যালঘু নির্যাতন, অরাজক পরিবেশ, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হোক বা চিন ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের মাখামাখি সম্পর্ক। আবার ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনার প্রত্যবর্তন চেয়ে ঢাকার লাগাতার চাপ সৃষ্টির কৌশল ভারত মোকাবিলা করে আসছিল কূটনৈতিক পরিভাষায়। এবার দেখা যাচ্ছে ভারত ঝটিকা আক্রমণ করছে। বাংলাদেশের জন্য একের পর এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সেই সঙ্গে ভারতের তরফে বাংলাদেশকে কার্যত হুঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে। যা এতদিন শোনা যায়নি কোনও ভারতীয় কূটনৈতিক অথবা মন্ত্রীদের মুখে। যেমন বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর, তিনি পাকিস্তান সম্পর্কে বিগত ছয়-সাত মাসে বেশ কয়েকবার কঠোর মন্তব্য করেছেন।
কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে তিনি নিরবই ছিলেন। এবার তাঁর মুখে শোনা গেল প্রচ্ছন্ন হুমকির সুর। দিল্লির ওই অনুষ্ঠানে মোদি-ইউনুস বৈঠক নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে জয়শংকর জানান, “ঐতিহাসিক দিক থেকেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশের মানুষের সংযোগের কারণে এই সম্পর্ক গড়ে উঠেছে”। অর্থাৎ, তিনি বলতে চাইলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে আত্মীক সম্পর্ক রয়েছে সেই বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে। সেখানে ইউনূসের তদারকি সরকার খুব একটা বড় ফ্যক্টর নয়। কূটনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা, ভারতের বিদেশমন্ত্রী বলতে চাইছেন, এই তদারকি সরকারের সঙ্গে ভারত খুব একটা যোগাযোগ রাখতে চাইছে না যেহেতু এই সরকার নির্বাচিত নয়।
এরপরেই জয়শংকরের তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, “অন্য কোনও দেশ আমাদের থেকে বেশি বাংলাদেশের ভালো চাইতে পারে না। এটা আমাদের ডিএনএ-তে রয়েছে। একজন শুভাকাঙ্ক্ষী ও বন্ধু হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি, ওরা সঠিক পথে হাঁটবে এবং সঠিক কাজ করবে”। কূটনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা, কোনও বড় পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের। তারই আগাম ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী। পাশাপাশি তিনি এও বোঝাতে চাইলেন, বাংলাদেশ এই মুহূর্তে সঠিক পথে হাঁটছে না। অর্থাৎ, চিন ও পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে বাংলাদেশ কার্যত নিজেদের বিপদই ডেকে আনছে। অপরদিকে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গে জয়শঙ্কর বলেন, “আশা করি, নির্বাচন শিগগিরই অনুষ্ঠিত হবে। দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য আছে। আর গণতন্ত্রে নির্বাচন জরুরি। নির্বাচনই অধিকার অর্পণ করে। আশা করি, বাংলাদেশও সেই পথেই এগোবে”।
আদতে ভারতের বিদেশমন্ত্রী বলতে চাইছেন, ভারত বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকারের সঙ্গেই সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী। এবং বাংলাদেশের সুষ্ঠ ও অবাধ নির্বাচন নিয়ে ভারতের কোনও পরিকল্পনা রয়েছে। জয়শঙ্করের এই বক্তব্য নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলের দাবি, একসময় ভারত শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে বাংলাদেশের নির্বাচনে নাক গলিয়েছে। এবার তা সম্ভব নয়। ফলে ভারত যতই বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করুক না কেন, মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে তাঁদের মেনে নিতেই হবে। অপরদিকে ভারতীয় কূটনৈতিক মহল মনে করছে, ভারত এবার চারদিক দিয়ে ঘিরছে বাংলাদেশকে। একের পর এক কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশকে আটকে দেওয়া হচ্ছে। ফলে এই চাপ খুব বেশি দিন ধরে রাখতে পারবেন না মুহাম্মদ ইউনূস।
Discussion about this post