বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানে অন্তর্বর্তী, মধ্যবর্তী কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন বিধান নেই। সেই অনুযায়ী এই মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনও গুরুত্বই নেই। তবে, রাষ্ট্রের জরুরি প্রয়োজনে বা আপাতকালীন পরিস্থিতিতে এরকম একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যায় বলে সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনজ্ঞ এমনকি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতও জানিয়েছে। তা বলে এই সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়, এটা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই।
আইনজ্ঞরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার বলে কোনও বিধান যেহেতু সংবিধানে নেই, সেহেতু এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টারা প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের জন্য নির্ধারিত শপথবাক্য পাঠ করেছেন। পাশাপাশি তাঁরা বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় তফসিল, ১৪৮ অনুচ্ছেদে বলা বিদ্যমান সংবিধান রক্ষারই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শপথবাক্যে প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টারা যে শপথবাক্য পাঠ করেছিলেন তা হল, ‘আমি সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, আমি আইন অনুযায়ী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টা পদের কর্তব্য বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব। আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব। আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান করিব। অর্থাৎ বর্তমানে যে সংবিধান বাংলাদেশে রয়েছে তা রক্ষা করার শপথ তাঁরা নিয়েছিলেন। তাহলে কোন অভিপ্রায়ে এই সরকার চাইছে দেশের সংবিধান বদল করতে? আসল উদ্দেশ্যটাই বা কি তাঁদের? এতে কি লাভ হতে পারে?
১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তানের বিজয়ী জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যরা পাকিস্তানের সংবিধানের আলোকে শপথ নেননি। বরং তারা নতুন করে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লিখে এবং পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান লেখার সংকল্প নিয়েছিলেন। এবং মুক্তিযুদ্ধের সেই ঘোষণাপত্র অনুযায়ী বাংলাদেশের নতুন সংবিধান লিখেছিলেন। স্বভাবতই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়েছেন এবং যে সংবিধান রক্ষায় তাঁরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তাঁরা কী করে এই সংবিধান পাল্টে নতুন করে লেখার কথা বলেন? সেই কারণেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তরফে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বলা হয়নি। যদিও আলোচনা শুরু হয়েছে। পাশাপাশি কয়েকটি সংস্কার কমিশনও গঠন করা হয়েছিল, যারা ইতিমধ্যেই তাঁদের সুপারিশগুলি জমা করেছে।
বাংলাদেশের আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় বাহাত্তরের মূল সংবিধানের মূলনীতি-সহ আরও অনেক অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনা হলেও নতুন অনেক কিছু যুক্ত করা হয়েছিল। যেমন: ৭ (ক) অনুচ্ছেদ যুক্ত করে বাংলাদেশ সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশ অনুচ্ছেদকে সংশোধন অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিল। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংবিধানের কোনও অনুচ্ছেদকেই সংশোধন অযোগ্য ঘোষণার এক্তিয়ার কোনও সংসদের নেই। কেননা পরবর্তী সংসদ যদি দেশ ও মানুষের প্রয়োজনে এবং জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সংবিধানে কোনও পরিবর্তন করতে চায়, সেই সুযোগ তাঁদের থাকা উচিত। একটি সংসদ আরেকটি সংসদের এক্তিয়ার সীমিত বা সীমাবদ্ধ করে দিতে পারে না। মূল বিতর্ক এখানেই। এখন দেখা যাক নতুন সংবিধান সংস্কার কমিশন কি কি সুপারিশ করল।
জানা যাচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন যে যে সুপারিশগুলি করেছে, তাতে বাদ পড়তে চলেছে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও বাঙালি জাতিয়তাবাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ শব্দগুলি। এমনকি বাংলাদেশের নামও বদলে যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর হাতে একছত্র ক্ষমতা হ্রাস করার জন্য পাঁচটি মূল নীতি তৈরির সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ডঃ আলী রীয়াজ। এই নীতিগুলি হল, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র। বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কার করা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে। একদিকে যেমন বিএনপি, জামাতের মতো দলগুলির কিছু দাবি এই সুপারিশে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে, তেমনই কিছু সুপারিশ নিয়ে আপত্তি বাংলাদেশের বাম দলগুলির। রাজনৈতিক এবং আইনজ্ঞ মহলের একাংশ বলছেন, তদারকি সরকার এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব চাইছে, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পুরোপুরি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিগণিত করা, এতে লাভবান হবে জামাতের মতো কট্টরপন্থীরা।
Discussion about this post