বিখ্যাত কমিক চরিত্র অরণ্যদেবের নাম আমরা সকলেই জানি। যিনি সকলের অলক্ষ্যে অরণ্যের গাছ, পশুপাখিদের রক্ষা করতেন। কিন্তু জানেন কি, আমাদের সমাজেও কয়েকজন অরণ্যদেব আছেন, যারা সকলের অলক্ষ্যে আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীকে রক্ষা করতে একমনে কাজ করে চলেছেন বা করেছেন। আজ আপনাদের সেকরমই এক অরণ্যদেবের গল্প শোনাবো। যাকে অনায়াসে ভারতের অরণ্যদেব বলা চলে।
সালটা ১৯৭৮-৭৯ হবে। অসমের ব্রহ্মপুত্র নদের মাজুলি দ্বীপ। তখন ছিল ধু-ধু বালুচর। সেখানেই খেলা করতো এক বছর ষলোর কিশোর। নাম তার যাদব পায়েং। মাজুলি দ্বীপের প্রতি তাঁর ছিল এক আলাদা অনুভূতি। একদিন যাদব দেখতে পায় মাজুলি দ্বীপের বালুচরে কয়েকটি সাপ মরে পড়ে রয়েছে। সেই দৃশ্য দেখার পর থেকে একটা কষ্ট কুড়ে কুড়ে খেতে শুরু করল কিশোর যাদব পায়েংকে। তাঁর মনে ঘুরে ফিরে আসে একটাই ভাবনা, গাছপালাহীন এই ধু ধু বালুচরে পশুপাথি, স্বরিসৃপদের জন্য নেই কোনও আশ্রয়স্থল। এরপরই সেই কিশোর শুরু করে এক অসাধ্য সাধন। ব্রহ্মপুত্র নদের মাঝে জেগে ওঠা মাজুলি দ্বীপে সে রোপণ করতে শুরু করল একের পর এক গাছ। আর তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মাজুলি দ্বীপ হয়ে উঠল এক বৃহৎ অরণ্যে।
প্রকৃতি যতটা দেয়, ফিরিয়ে নেয় তার দ্বিগুণ। এই আপ্তবাক্যটি ভুলে গিয়ে আধুনিক জীবনযাপণে অভ্যস্ত বর্তমান প্রজন্ম মেতেছে এক মারণ ধ্বংসলীলায়। ফলে প্রকৃতিও বারবার তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। ফি বছর বন্যা, ভূমিধস, হড়পা বান, ঘূর্ণিঝড় লেগেই আছে। মারা যাচ্ছে, শত শত মানুষ। সেই সঙ্গে রক্ষা পাচ্ছে না গবাদি পশু, বন্যপ্রাণও। গবেষকরা এই জন্য দায়ী করছেন প্রকৃতিকে ধ্বংস কারকেই। যেমন গাছ কাটা, পুকুর বুজিয়ে দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। মানবজাতীকে এর জন্য দায়ী করা যায় অনায়াসে। কিন্তু সব মানুষতো আর সমান হয় না। যেমন যাদব পায়েং। অসমের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই কিশোর তাঁর সারাজীবন ব্যয় করেছেন অরণ্য সৃষ্টিতে। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন, একটা গোটা অরণ্য সৃষ্টিতে।
প্রকৃত নাম যাদব পায়েং, তবে নিজের এলাকায় তিনি মোলাই পায়েং নামেই বেশি পরিচিত। প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি একের পর এক গাছ লাগিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের বালুচরে সৃষ্টি করেছেন ১৩৬০ একরের আস্ত একটা বনাঞ্চল। অসমের জোরহাট জেলার কোকিলামুখের কাছে ব্রক্ষ্ণপুত্রের চরায় সেই বনাঞ্চলকে আজ বলা হয় ‘মোলাই কাঠনবাড়ি’। বনসৃজনের এই কর্মকাণ্ড তাঁকে এনে দিয়েছে বহু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সম্মান। তাঁকে নিয়ে তৈরি হয়েছে একাধিক তথ্যচিত্র। এমনকি দক্ষিণ ভারতে তৈরি হয়েছে একটি পূর্ণদৈর্ঘের সিনেমাও। ২০১৫ সালে ভারত সরকারের পদ্মশ্রী সম্মনে সম্মানিত যাদব ওরফে মোলাই পায়েংকে বলা হয় “ফরেস্ট ম্যান অফ ইন্ডিয়া”।
১৯৬৩ সালে অসমের জোরহাট জেলার কোকিলামুখ গ্রামে জন্ম যাদব পায়েংয়ের। আর বনভূমি তৈরির কাজে হাত দেন ১৯৭৯ সাল নাগাদ। যাদবের কথায়, একটি বাঁশ গাছের চারা পুঁতে শুরু করেছিলেন তিনি। এরপর মাজুলি দ্বীপে তিনি রোপণ করেন নানা রকমের গাছ। এরপর রীতিমতো ম্যাজিক দেখে বিশ্ববাসী। ওই মনুষ্যসৃষ্ট বনভূমিতে আশ্রয় পায় রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, গণ্ডার, হাতি-সহ অসংখ্য প্রজাতির বন্যপ্রাণ। পাশাপাশি হরেক রকমের সাপ, পাখির আশ্রয়স্থল ওই বনভূমি। অসমের বাসিন্দারা মাজুলিকে আদর করে এখন মিনি কাজিরঙ্গা বলেও ডাকেন। আর যার একার হাতে তৈরি এই মিনি কাজিরঙ্গা, সেই ভারতের অরণ্যদেব যাদব পায়েং এখন ডাক পাচ্ছেন মেক্সিকো, দুবাইয়ের মতো দেশ থেকে নতুন করে বনসৃজন করার জন্য।
Discussion about this post