ফিরে দেখা ২০২৪। নতুন বছরে প্রবেশ করার আগে একবার ফেলে আসা বছরের খতিয়ান জেনে নেওয়া প্রয়োজন। কারণ এই ২০২৪ সালে ভারত নিজেকে বিশ্বের অন্যতম সুপার পাওয়ারে নিয়ে গিয়েছে। অর্থনীতি থেকে মহাকাশ গবেষণা বা প্রতিরক্ষা থেকে আত্মনির্ভর ভারত এখন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ। আর মাত্র দুদিন, তারপরেই আমরা প্রবেশ করবো এক নতুন বছরে। হ্যাঁ, অনেক আশা ও নিরাশার মধ্যে দিয়ে আমরা পার করে ফেললাম ২০২৪ সাল। তাই বছরের শেষ দিকে এসে আমরা ফিরে দেখি ভারতের সাফল্য ও ব্যর্থতার কাহিনীগুলি। কোনওটা যেমন অত্যন্ত সুখের, আবার কোনওটা হতাশার।
মহাকাশ অন্বেষণ থেকে খেলাধুলার জয়, এবং কূটনৈতিক বিজয় থেকে পরিবেশগত সাফল্য, ভারতের বিজয়রথ ২০২৪ সালে অনেকটাই এগিয়েছে। যা আত্মনির্ভর ভারতের অলঙ্ঘনীয় অগ্রগতির প্রদর্শন বলা যেতে পারে। এমনটা বলা যেতেই পারে ২০২৪ সাল আত্মনির্ভর ভারতের এক উল্লেখযোগ্য বছর। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন বা ইসরো। ২০২৪ সালে ইসরো অনেকগুলো সাফল্য পেয়েছে, ব্যর্থতা বলতে গেলে নগন্য। সাফল্যগুলির মধ্যে যেমন রয়েছে এক্সরে পোলিরিমিটার স্যাটেলাইট বা এক্সপোস্যাট লঞ্চ। ২০২৪ সালের প্রথমদিন অর্থাৎ ১ জানুয়ারি ভারত সফলভাবে এক্সপোস্যাট লঞ্চ করে গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলো। এই কৃত্তিম উপগ্রহ এক্স-রের মাধ্যমে পালসার, ব্ল্যাক হোল এবং সক্রিয় গ্যালাকটিক নিউক্লিয়াসের মতো বেশ কিছু মহাজাগতিক ঘটনা অধ্যয়ন করবে।
বেঙ্গালুরুর রমন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় এই স্যাটেলাইট তৈরি করেছিল ইসরো। যা আত্মনির্ভর ভারতের এক উচ্চাকাঙ্খী প্রকল্প। অপরদিকে ইসরো ভারতের প্রথম সৌর মিশন আদিত্য-L1 কে সফলভাবে সূর্যের নির্দিষ্ট কক্ষপথে প্রতিস্থাপন করেছে ২০২৪ সালের জুন মাসে। প্রথম প্রচেষ্টায় সূর্যের কাছাকাছি কোনও কৃত্তিম মানমন্দির স্থাপন করা ইসরো-র উৎকৃষ্টতা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে ভারত। পৃথিবী থেকে দেড় মিলিয়ন কিমি দূরত্বে অবস্থিত কক্ষপথে প্রতিস্থাপিত আদিত্য-এল১-এর লক্ষ্য সূর্যের বিকিরণ, তাপ এবং চৌম্বকীয় ক্ষেত্রগুলি অধ্যয়ন করা। যা ভারতের বৈজ্ঞানিক সাধনার একটি স্মারক পদক্ষেপ বলেই বিবেচিত হবে। এছাড়া ভারতের মহাকাশ কর্মসূচিও সারা বছর ধরেই বেড়েছে। যেমন ভারতের চন্দ্রযান-৩ মিশন। এক বছর আগে চালু করা চন্দ্রযান-৩ মিশন ২০২৪ সালে চন্দ্রপৃষ্ঠে উল্লেখযোগ্য সাফল্য এনে দিয়েছে ভারতকে। যা চাঁদের মাটির বহু অজানা ও আশ্চর্যজনক তথ্য পাঠিয়ে গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়েছে। নতুন এই আবিষ্কারে চন্দ্রযান ৩ জানায় চন্দ্র পৃষ্ঠে একটি তরল ম্যাগমা মহাসাগর বিদ্যমান ছিল। ফলে এই মুহূর্তে ভারত মহাকাশ গবেষণায় নেতৃত্ব স্থানে পৌঁছে গিয়েছে।
মহাকাশ গবেষণার পাশাপাশি অর্থনীতির দিক থেকেও ২০২৪ সালে ভারত উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার তথ্য অনুসারে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেছে। মূলত বৈদশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিক থেকে ভারত এই স্থান অর্জন করেছে। ফলে ভারত এখন আর উন্নয়নশীল দেশ নয়, রীতিমতো উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে। ২০০০ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ভারতের প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ রেকর্ড এক ট্রিলিয়নে পৌঁছে গিয়েছে। এবং বৈদশিক মুদ্রার ভাণ্ডার বর্তমানে ৭০৪.৮৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পাশাপাশি ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ভারতের গোল্ড বা স্বর্ণ রিজার্ভের পরিমান দাঁড়িয়েছে ৬৫.৭৪৯ বিলিয়ন ডলার। যা ভারতের অর্থনীতিকে আরও চাঙ্গা করতে সাহায্য করছে। অপরদিকে এই ২০২৪ সালে ভারতীয় কোম্পানিগুলি ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং বা আইপিও-তে ১.৬ লক্ষ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে বলে জানা গিয়েছে। এলআইসি থেকে হুন্ডাই মোটরস, বা সুইগি চলতি বছরে আইপিও ছেড়ে ব্যাপক মুনাফা অর্জন করেছে।
প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে আত্মনির্ভর ভারতের সাফল্য এক অন্যমাত্রা এনে দিয়েছে ভারতকে। ২০২৪ সালে চিনের সঙ্গে সংঘাতের দিক থেকে এক উল্লেথযোগ্য বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। বিশেষ করে উচ্চ হিমালয় অঞ্চলে দুই দেশের সেনাবাহিনীর সংঘাতের আহবে তা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। চলতি বছরে চিনের সাথে লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলে বা এলএসি-তে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক অর্জিত হয়েছে। ভারতের কূটনৈতিক ও সামরিক কৌশলের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে চিন। চলতি বছর ভারত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রফতানিতে এক উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে দেশীয় উৎপাদন ১ লক্ষ ২৬ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। যা আগের বছরের তুলনায় ১৬.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি এই বছর ভারত ২১ হাডার কোটি টাকার বেশি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিদেশে রফতানি করেছে। যা আগের বছরের তুলনায় ২০.৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বছরই গুজরাটের ভাদোদরায় টাটাদের এয়ারক্রাফ্ট কমপ্লেক্স উদ্বোধন হয়েছে, যেখানে তৈরি হবে সি-২৯৫ এর মতো উন্নতমানের পরিবহন বিমান। ভারত এই বছর প্রতিরক্ষা আধুনিকায়নে উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিগত মাইলফলক অর্জন করেছে। ইন্ডিয়ান লাইট ট্যাঙ্ক ‘জোরাওয়ার’ সফলভাবে উচ্চ-উচ্চতা এবং মরুভূমিতে কঠোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। নৌবাহিনীর জন্য অত্যাধুনিক পারমানবিক সাবমেরিন আইএনএস আরিঘাট এবং স্টিলথ গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট পর্যায়ের যুদ্ধজাহাজ আইএনএস তুশিল ভারতীয় নৌসেনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। চলতি বছরে ভারতীয় বিমান বাহিনী দেশীয় কাউন্টার-ড্রোন প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করতে সক্ষম হয়েছে। সবমিলিয়ে ভারত ২০২৪ সালে পৃথিবীর এক অন্যতম শক্তিশালী দেশে পরিণত হয়েছে বলাই যায়।
Discussion about this post