প্রয়াত রতন টাটা। গোটা দেশ যখন দুর্গাপুজো, নবরাত্রীর উৎসবে মগ্ন, তখন সকলের অগচোরে মুম্বইয়ের এক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন টাটা সন্সের চেয়ারম্যান এমেরিটাস রতন টাটা। যার দিকে বিশ্বের সমস্ত মিডিয়াকুলের ফোকাস থাকলেও তিনি নিজে আড়ালে থাকতেই পছন্দ করতেন। ভারতের অন্যতম প্রধান শিল্পপতি হলেও রতন টাটা জনপ্রিয় তাঁর জনহিতৈষী কাজের জন্য। কার্যত বিতর্কহীন, অকৃতদ্বার এই প্রবীন শিল্পপতি নিজের জীবন অতিবাহিত করতেন অতি সাধারণ ভাবে। কিন্তু তাঁর ব্যবসায়ীক দক্ষতা, দূরদৃষ্টি, কঠোর পরিশ্রম এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার অদ্ভুত ক্ষমতা তাঁকে নিয়ে গিয়েছে সর্বোচ্চ শিখরে। নিতান্ত পারিবারিক ব্যবসাকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। শিল্পপতি হিসেবে রতন টাটা দেশ গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। ফলে তাঁর প্রয়ানের খবর ছড়িয়ে পড়তেই গোটা দেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
১৯৩৭ সালে টাটা পরিবারে জন্মগ্রহন করেন রতন টাটা। কিন্তু তাঁর ১০ বছর বয়সের মাথায় বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। ফলে তাঁকে মানুষ করার দায়িত্ব নেন তাঁর ঠাকুমা। তিনিই মূলত ছোট্ট রতনকে দেশের রত্ন হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। দেশে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে রতন পারি জমান মার্কিন মূলুকে। সেখানকার কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে আর্কিটেকচার ও স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ডিগ্রি এবং হার্ভার্ড অ্যাডভান্সড ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপরই আইবিএম কোম্পানি তাঁকে মোটা বেতনের চাকরি অফার করেছিল। কিন্তু যার রক্তে ব্যবসা মিশে আছে, তিনি কেন চাকরি করবেন? ফলে ১৯৬২ রতন টাটা যোগ দেন পারিবারিক সংস্থা টেলকোতে। খুব ছোট কাজ ছিল, কিন্তু তিনি মন দিয়ে অন্যান্য শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করতেন। এরপর টাটা গ্রুপের বিভিন্ন সংস্থায় বিভিন্ন পদে কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ১৯৭২ সালে প্রথম উঁচু পদে আসেন রতন টাটা। ৯ বছর কঠোর পরিশ্রম করার পর ন্যাশনাল রেডিয়ো অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স বা নেলকোর ডিরেক্টর পদে যোগ দেন তিনি।
এ কথা বলাই যায়, রতন টাটার হাত ধরেই টাটা সাম্রাজ্যের বিস্তার হয়েছিল। নুন থেকে উড়োজাহাজ সব ব্যবসাই করে টাটা গোষ্ঠী। পাশাপাশি সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রযুক্তি শিল্পেও রতন টাটা সমান উৎসাহী ছিলেন। তিনিই টাটা কনসাল্টেন্সি সার্ভিসের জনক। নব্বইয়ের দশকে যখন ভারত আর্থিক উদারনীতির পথে হাঁটতে শুরু করল, ঠিক সেই সময়ই রতন টাটা জে আর ডি টাটার হাত থেকে টাটা সন্স এবং টাটা ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব হাতে নেন। এরপরই রতন টাটা তাঁর দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়ে টাটা গ্রুপের পুনর্গঠন শুরু করেন। তাঁর বিচক্ষণ নেতৃত্বে টাটা গোষ্ঠী ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল গোটা বিশ্বব্যাপী। একের পর এক বড় সংস্থা অধিগ্রহন করল টাটা গ্রুপ। ১০০টিরও বেশি দেশে পৌঁছে গিয়েছিল টাটা গ্রুপ। রতন টাটার বিখ্যাত উক্তিগুলির মধ্যে অন্যতম হল “সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হল কোনও ঝুঁকি না নেওয়া”। ফলে তাঁর জীবনে তিনি অনেক বড় বড় ঝুঁকি নিয়েছেন, কিন্তু কোনও বার ব্যর্থ হননি।
ভারতের সবচেয়ে বড় শিল্পগোষ্ঠী টাটা সন্সের চেয়ারম্যান হয়েও রতন টাটা কোনও দিন বিশ্বের ১০০ জন তাবড় ধনীদের তালিকায় আসেননি। এটা সত্যিই কোনও ম্যাজিক নয়। আদানি, আম্বানীদের থেকেও টাটা গ্রুপের ব্যবসা বহুগুণ প্রসারিত। তবুও ২০২১ সালের ভারতের ধনীদের তালিকায় রতন টাটা ছিলেন ৪৩৩ তম স্থানে। এর অন্যতম এবং একমাত্র কারণ হল রতন টাটা তাঁর রোজগারের অধিকাংশই জনহিতকর কাজে ব্যয় করতেন। রান্নাঘরের লবন থেকে উড়োজাহাজ পর্যন্ত টাটা গ্রুপের অধীনে ১০০টির বেশি সংস্থা নথিভূক্ত রয়েছে। তাঁদের মোট টার্নওভার প্রায় ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে এই সংস্থাগুলির মধ্যে একটি হল টাটা ট্রাস্ট। এই টাটা ট্রাস্ট গোটা বিশ্বেই বিভিন্ন জনকল্যাণকর কাজ করে চলেছে অবিরত। রতন টাটা নিজে তাঁর রোজগারের একটা বড় অংশই টাটা ট্রাস্টে দান করতেন। আর টাটা ট্রাস্টের হোল্ডিং কোম্পানির অধীনে থাকা সংস্থাগুলির মোট উপার্জনের ৬৬ শতাংশ দান করা হয়। তাই ২০০৪ সালের ভয়াবহ সুনামি হোক বা ২০২০ সালের করোনা ভাইরাসের আক্রমণ। প্রতিটি সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতেই টাটা গোষ্ঠী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমানে ভারতের সর্ববৃহৎ দাতব্য সংস্থা হল টাটা ট্রাস্ট ফাউন্ডেশন। শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা, গ্রামোন্নয়ন – সমস্ত ক্ষেত্রে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে টাটা ট্রাস্ট। এখানেই শেষ নয়, তিনি নিজে যেহেতু একেবারে নিচু তলা থেকে কাজ শুরু করেছিলেন। তাই সাধারণ কর্মীদের চাহিদাও রতন টাটা বুঝতেন পরিবারের সর্বময় কর্তার মতো।
Discussion about this post