গত বছর ওড়িশার বালাসোরে দুর্ঘটনার কবলে পরেছিল করমণ্ডল এক্সপ্রেস এবং বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস। তাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় ২৯৬ জন যাত্রী। সেই দুর্ঘটনার তদন্তে উঠে এসেছিল স্বয়ংক্রিয় সিগনাল খারাপ থাকার ঘটনা। ট্রেন চলছিল রেলের কাগুজে সিগনাল বা টিএ-৯১২ ফর্ম নিয়ে। একবছর বাদে সেই জুন মাসেই ঘটল ভয়াবহ দুর্ঘটনা। এবার নিউ জলপাইগুড়ির কাছে রাঙাপানি স্টেশনে। এবারও কাঠগোড়ায় খারাপ স্বয়ংক্রিয় সিগনাল এবং টিএ-৯১২ ফর্ম। অন্তর্তদন্তে উঠে আসছে ভয়াবহ তথ্য।
তেরোর গেড়ো! সোমবার সকাল ৮টা ৪২ মিনিটে রাঙাপানি স্টেশন থেকে ছেড়ে যায় মালগাড়িটি। এর মাঝে ব্যবধান মাত্র ১৩ মিনিটের। ঠিক সকাল ৮টা ৫৫ মিনিটে প্রবল গতিতে দৈত্যের মতো শিয়ালদাগামী ডাউন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনে ঝাপিয়ে পড়ে সেই অভিসপ্ত মালগাড়ি। যার ফলস্রুতি, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুটি পার্সেল ভ্যান, একটি গার্ডের কামরা এবং একটি জেনারেল কামরা কার্যত দুমড়ে মুচড়ে গেল। দূর্ঘটনার অভিঘাতে এখনও পর্যন্ত প্রাণ গিয়েছে ১০ জনের, আহত প্রায় ৫০ জন। বিশেষজ্ঞদের দাবি, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনে দুটি পার্সেল ভ্যান না থাকলে হতাহতের সংখ্যা অনেক বেড়ে যেত। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে ঠিক কি কারণে এত বড় দূর্ঘটনা ঘটল? কেনই বা দিনের আলোয় মালগাড়ির চালক সামনে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসকে দেখতেই পেলেন না, মালগাড়িটি ঠিক কত গতিবেগে চলছিল? এই সমস্ত প্রশ্নের মধ্যেই উঠে আসছে সিগনাল বিভ্রাটের তথ্য।
সোমবার ভোর ৫.৫০ মিনিট নাগাদ রেলকর্মীরা খেয়াল করেন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের কাছেই রাঙাপানি এবং চটেরহাট স্টেশনের মাঝে কাজ করছে না স্বয়ংক্রিয় সিগনালগুলি। এই পরিস্থিতিতে যা করণীয়, তাই করেন স্টেশনমাস্টার থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট রেলকর্মীরা। সেটা হল খারাপ সিগনালগুলি পার করার জন্য প্রতিটি যাত্রীবাহী এবং মালবাহী ট্রেনের গার্ড এবং ড্রাইভারের কাছে দেওয়া হয় কাগুজে অনুমতি। যার আক্ষরিক নাম হল পেপার লাইন ক্লিয়ার টিকিট বা টিএ-৯১২ ফর্ম। এই অনুমতিপত্র নিয়ে রেলের নির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই ওই খারাপ সিগনালগুলি পার করতে হয় ট্রেনচালকদের। কি সেই নিয়ম? সেটা হল প্রতিটি খারাপ সিগনালের সামনে অন্তত এক মিনিট দাঁড়াতে হবে, এরপর অত্যন্ত ধীর গতিতে বা ঘণ্টায় ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার গতিতে পরের সিগনাল পর্যন্ত যেতে হবে। এর মধ্যে যদি সামনে কোনও ট্রেন থাকে, তবে সেই ট্রেনের অন্তত ১৫০ মিটার আগে ট্রেনটি থামিয়ে দেবেন পিছনের ট্রেনের চালক। এখন প্রশ্ন হল, দূর্ঘটনাগ্রস্থ মালগাড়ির চালক কি এই নিয়ম মেনেছিলেন? মালগাড়ির গার্ড কি করছিলেন।
রেল সূত্রে জানা যাচ্ছে, সোমবার নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন ছেড়ে রাঙাপানি স্টেশনে এসে ডাউন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের গার্ড এবং চালক নিয়ম মেনেই টিএ-৯১২ ফর্ম নিয়েছিলেন স্টেশন মাস্টারের কাছ থেকে। রাঙাপানি এবং চটের হাট স্টেশনের মাঝে মোট ৯টি স্বয়ংক্রিয় সিগনাল খারাপ ছিল। টিএ-৯১২ ফর্মে সেই সিগনালের সমস্ত তথ্য দেওয়া ছিল। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের চালক নিয়ম মেনেই ৯টি সিগনাল পার করেন এবং পরবর্তী নির্দেশের জন্য দূর্ঘটনাস্থলে ট্রেনটি দাঁড় করিয়েছিলেন। সেই সুহূর্তেই পিছনে চলে আসে মালগাড়িটি। তবে কী মালগাড়ির চালক টিএ-৯১২ ফর্ম পাননি? রেলের বক্তব্য, রাঙাপানির স্টেশন মাস্টার ওই মালগাড়ির চালক এবং গার্ডকেও টিএ-৯১২ ফর্ম দিয়েছিলেন। মাঝে ১৫ মিনিটের ব্যবধানে মালগাড়ির চালককে এগিয়ে যাওয়ার সিগনাল দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন : KAVACH System থাকলে ঘটতো না এই দূর্ঘটনা, কি এই ‘কবচ’?
কিন্তু মাত্র ১৩ মিনিটের ব্যবধানেই মালগাড়ি কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনে সজোরে ধাক্কা মারে। তবে কী মালগাড়ির চালক রেলের নিয়ম মানেননি? ধাক্কার অভিঘাত দেখে বোঝাই যাচ্ছে, মালগাড়ির গতিবেগ যথেষ্টই ছিল। না হলে কাঞ্চনজঙ্ঘার পিছনের একটি পার্সেল কামরা ইঞ্জিনের উপরে উঠে যেত না। রেলের একাংশের দাবি, মালগাড়ির চালক নিয়ম লঙ্ঘন করে গাড়ির গতি ঘণ্টায় ১৫ কিলোমিটারে নিয়ন্ত্রন করেননি। সূত্রের খবর, রেলওয়ে সেফটি কমিশনার জনককুমার গর্গ তদ্তে জানতে পেরেছেন, দুর্ঘটনার আগে মালগাড়িটির গতি ছিল ঘণ্টায় ৭৮ কিলোমিটার। প্রত্যক্ষদর্শীরাও দাবি করছেন, মালগাড়িটি যথেষ্ট গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছিল। এখানেই প্রশ্ন, ওই মালগাড়ির গার্ড কেন চালককে সাবধান করেননি।
রেল সূত্রে জানা যাচ্ছে, বুধবার থেকে দূর্ঘটনার কারণ জানতে শুরু হবে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত। এই দূর্ঘটনার তদন্তের দায়িত্বে রয়েছেন উত্তর-পূর্ব রেলওয়ের সেফটি কমিশনার জনককুমার গর্গ। পাশাপাশি দূর্ঘটনার পর এক আহত যাত্রী রেলপুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। তাঁর এফআইআরের ভিত্তিতে তদন্ত করবে রেলপুলিশও। সূত্র মারফৎ জানা যাচ্ছে, দূর্ঘটনাগ্রস্থ মালগাড়ির চালক অনিল কুমারের মৃত্যু হলেও প্রাণে বেঁচেছেন সহকারী চালক মন্নু কুমার। যদিও তিনি গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন। মারা গিয়েছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের গার্ড আশীষ দে। এখন দেখার রেলের তদন্তে দূর্ঘটনার সঠিক কোন কারণটি উঠে আসে। প্রসঙ্গত, গতবছর এই জুন মাসেই ওড়িশার বালাসোরে করমণ্ডল এক্সপ্রেস দূর্ঘটনার সময়ও স্বয়ংক্রিয় সিগনাল খারাপ ছিল। ওই সেকশনে পেপার লাইন ক্লিয়ার টিকিট দিয়েই চলছিল ট্রেন। এবারও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
Discussion about this post