সুন্দরবনের জলে-জঙ্গলে বাঘ ও কুমির নিয়ে অনেক মিথ রয়েছে। সুন্দরবন মানেই “জলে কুমির ডাঙায় বাঘ”। তবে বঙ্গপোসাগরের গা ঘেঁষে এই দ্বীপগুলিতে ইদানিং আরও একটি ভয়াল দানবের হাজির হওয়ার ভয় দেখা দিচ্ছে। সেটা হল ফি বছর এপ্রিল-মে মাসের প্যাঁচপ্যাচে গরমে বঙ্গপোসাগরে সৃষ্টি হওয়া একেকটি ঘূর্ণিঝড়। যা বরাবর এই সুন্দবন লাগোয়া কোনও এলাকার স্থলভাগে আছড়ে পড়ে সর্বশক্তি নিয়ে। গত ৩০ বছর ধরে সুন্দরবনবাসী অসংখ্য ঝড়-ঝঞ্ঝার সাক্ষী। এরমধ্যে বেশ কয়েকটি ভয়াল ঘূর্ণিঝড় হিসেবে দাগ কেটেছে। আর প্রতিটি ঝড়-ঝঞ্ঝাতেই একজন পৌড় মানুষকে দেখা গিয়েছে ধুতির খুট কোমরে বেঁধে ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পথেঘাটে ঘুরে বিপন্ন মানুষ, গবাদী পশুদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন। কখনও গ্রামবাসীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভেঙে যাওয়া নদীবাঁধ মেরামত করতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছেন। তিনি কান্তি গাঙ্গুলি। যিনি সেই বাম আমলের দাপুটে নেতা, একদা সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী।
ক্ষমতায় না থাকলেও যে মানুষের পাশে থাকা যায়, একথা বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক নেতাদের চোখে আঙুল দিয়ে বারংবার দেখিয়ে দিয়েছেন অশীতিপর কান্তি গাঙ্গুলি। তাই সুন্দরবনের নতুন মিথ, “ঝড়ের আগে কান্তি আসে”। বিগত বছরগুলির শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, আয়লা থেকে শুরু করে, বুলবুল, আমপান, ইয়াস হোক বা এবারের রেমাল, অসতিপর কান্তিবাবু হাজির স্বমহিমায়। সাম্প্রতিক রেমালের কথা মাথায় রেখে রায়দিঘিতে সেফ হাউস খুলেছেন কান্তিবাবু। সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন অসংখ্য সাধারণ মানুষ। পাশাপাশি নদীর পাড়গুলিতে গিয়ে বুঝে নিয়েছেন পরিস্থিতি কতটা খারাপ আকার নিতে পারে। রবিবার রাতে ঘূর্ণিঝড় রেমাল সাগরদ্বীপ লাগোয়া বাংলাদেশে আছড়ে পড়ার পর, সোমবার ভোর থেকেই তিনি পথে নেমেছেন দুর্গতদের উদ্ধারে।
পরনে সাদা পাঞ্জাবি ও ধুতি, কাঁধে গামছা। প্রয়োজনে ধুতি হাঁটুর ওপরে শক্ত করে বেঁধে ছাতা মাথায় সুন্দরবনের কর্দমাক্ত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন ৮০ পার হওয়া কান্তি গাঙ্গুলি। ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ ঝখন ধীরে ধীরে নখ, দাঁত বের করে উপকূলের দিকে এগিয়ে আসছে, তখন থেকেই পথে নেমেছিলেন কান্তিবুড়ো। এক হাতে ছাতা ও অন্য হাতে ধুতির খুঁট, নদীর পাড় ধরে হেঁটে চলেছেন কান্তি গাঙ্গুলি, এই দৃশ্য এখন গেঁথে আছে কালিংপঙ থেকে কাকদ্বীপের অপামর বাঙালির। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য ঝড় দেখা কান্তি গাঙ্গুলি আবহাওয়া নিয়েও সমান সতর্ক। রবিবার রাতে ঘূর্ণিঝড় রেমাল স্থলভাগে আছড়ে পড়ার আগে যেমন বললেন, “পূবের হাওয়া বইছে। আর পূবের হাওয়া বইতে শুরু করলে বুঝতে হবে সুন্দরবনের কপালে দুঃখ আছে”। স্বগক্তির সুরে তিনি আরও বলেন, “জোয়ারের সময় চারফুট জল বেড়ে যায়, আর যদি পূবের হাওয়া থাকে, তাহলেই সুন্দরবনের বিপদ। মাঝারি বিপদ পূব-দক্ষিণের হাওয়ায়। তাহলে নদীবাঁধ ভাঙার সম্ভবনা থাকে। আমফানের সময় হাওয়া পশ্চিমে ছিল তারপর পূবের দিকে ঘুরে যায়”। প্রবীণ এই বাম নেতা বরাবরই সুন্দরবনের অসহায় মানুষদের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
আগে বাম জমানায় দলীয় কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি চষে বেড়াতেন জল জঙ্গল ডিঙিয়ে গ্রাম থেকে গঞ্জে। এখন আর বাম জমানা নেই। দুই দশকের বেশি সময় রাজ্য শাসন করছে তৃণমূল কংগ্রেস। তবুও তিনি আছেন স্বমহিমায়। এবারও ঘূর্ণিঝড় রেমালের আছড়ে পড়ার আগে সুন্দরবনের অলিগলি ঘুরে বেরালেন কয়েকজন সর্বক্ষণের বাম কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে। বর্ষীয়ান বাম নেতা জানালেন, সারা বছরই দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য তৈরি থাকি। এবারও রেমাল আসার আগে প্রায় ১৫০ ছেলে-মেয়ে জুটে গিয়েছে। একটা সেফ হাউস খুলেছি। সারা বছর ধরেই ত্রিপল বা অন্যান্য ত্রাণসামগ্রী জোগার করে রেখেছি। সরকার মতো সেগুলি বিলি হবে। আমপান, বুলবুল, আয়লা, ইয়াস হোক বা হালফিলের রেমাল, ৮০ পেরোনো মানুষটা সবার আগে ঘূর্ণিঝড়ের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন, তিনিই কান্তি গাঙ্গুলি। তাই তো সোঁদরবনের মানুষদের মুখে মুখে ফেরে “ঝড়ের আগে কান্তি আসে”।
Discussion about this post