তিনি পশ্চিমবঙ্গে একাই টিমটিম করে জ্বালিয়ে রেখেছিলেন কংগ্রেসের প্রদীপ। তিনি বহরমপুরের ‘ডন’ অধীর রঞ্জন চৌধুরী। বিগত পাঁচটি লোকসভা ভোটে তাঁকে হারানোর মতো কাউকে পায়নি কোনও রাজনৈতিক দল। বহরমপুরের মাটিতে অধীরকে নিয়ে অসংখ্য মিথের জন্ম হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের লোকসভায় সেই সমস্ত মিথ মিথ্যা প্রমানিত করে তিনি হারলেন। বলা ভালো, বহরমপুরে অধীরকে হারাতে একটা মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সুদূর গুজরাট থেকে নিয়ে এসেছিলেন জাতীয় দলের তারকা ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠানকে। আর সেই মাস্টারস্ট্রোকেই বাজিমাৎ করল তৃণমূল। ভূপতিত হলেন অধীর, আর তাঁর ২৫ বছরের সাম্রাজ্য। ভেঙে গেল সব মিথ।
২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে ইন্ডিয়া জোটের নীতি মেনে বাংলায় কংগ্রেস এবং বামফ্রন্ট জোট করেছিল। কিন্তু খাতায় কলমে তৃণমূল ইন্ডিয়া জোটে থাকলেও বাংলায় একাই লড়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবার বহরমপুর আসনে মনোনয়নপত্র পেশ করার দিন অধীরের গলায় কাস্তে-হাতুরি-তারার লাল উত্তরীয় সকলেরই নজর কেড়েছিল। ভোট প্রচারেও এবার বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ আসনে কংগ্রেস-সিপিএমের মরিয়া চেষ্টা কম ছিল না। কিন্তু সব প্রচেষ্টাই মাঠে মারা গেল তৃণমূল নেত্রীর একটি চালে। প্রায় ৮৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতে দিল্লি যাচ্ছেন তৃণমূল প্রার্থী ইউসুফ পাঠান। তিনি ভোট পেয়েছেন প্রায় ৫ লক্ষ ১৮ হাডার ৬৬, অপরদিকে কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী পেয়েছেন ৪ লক্ষ ৩২ হাজার ৩৪০ ভোট। অন্যদিকে বহরমপুরে বিজেপির প্রার্থী ডঃ নির্মল কুমার সাহা পেয়েছেন ৩ লক্ষ ৬৪ হাজার ৩৬৯টি ভোট। সবমিলিয়ে রাজনীতির ময়দানে অনভিজ্ঞ ইউসুফ বহরমপুরের মতো আসনে অনায়াসে হারিয়ে দিলেন সংসদীয় রাজনীতিতে পাহাড় প্রমান অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অধীর চৌধুরীকে।
বহরমপুরের অধীর দূর্গ যে নড়বড়ে হয়েছে সেটার প্রমান পাওয়া গিয়েছিল একুশের বিধানসভা ভোটেই। কিন্তু সেটা মেরামত করতে সেরকম উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি অধীর চৌধুরীকে। একুশের ভোটে খোদ বহরমপুর বিধানসভা আসনে অধীরের অন্যতম অনুগামী মনোজ চক্রবর্তীকে হারিয়ে পদ্মফুল ফুটিয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থী সুব্রত মৈত্র। পাশাপাশি বহরমপুর লোকসভার বাকি ছটি আসনেই তৃণমূলের দাপটে ফুটেছিল ঘাসফুল। ফলে অধীর গড় সে বারই শূন্যে পৌঁছে গিয়েছিল। এই জয়ের পরই চব্বিশের লোকসভায় মমতার মাস্টারস্ট্রোক। সংখ্যালঘু অধুষ্যিত মুর্শিদাবাদ জেলায় বহরমপুর আসনে তিনি প্রার্থী করেন ইউসুফ পাঠানের মতো তারকাকে। যিনি জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন তারকা। আইপিএলেও তিনি সমান জনপ্রিয় ক্রিকেটার ছিলেন। সর্বপরি তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। ফলে বহরমপুরের মতো আসনে ইউসুফের জনপ্রিয়তা ছাপিয়ে গেল অধীরকে। যদিও লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে অধীর তৃণমূল নেত্রীকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছিলেন বহরমপুরে তাঁর বিরুদ্ধে যেন মমতা নিজে লড়েন। এর উত্তরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখে কিছু না বললেও ইউসুফকে প্রার্থী করে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছিলেন। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল সেটাই সামলাতে পারলেন না অধীর।
রাজনৈতিক মহলের মতে, বহু আগে থেকেই বহরমপুরে কংগ্রেসের সাংগঠনিক অবক্ষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। তবুও তা মেরামত করতে পারেননি অধীর। কংগ্রেসের সংগঠন চলে গিয়েছিল তৃণমূলের দখলে। কিন্তু আত্মবিশ্বাসে ভরপুর অধীর বারবার বলে এসেছেন, লোকসভা ভোটে তিনিই শেষ কথা। বহরমপুরে বরাবরই দেখা গিয়েছে, দিল্লির ভোট একেবারেই আলাদা। বিধানসভা হোক বা পুরসভা, পঞ্চায়েত ভোট, কংগ্রেস সেভাবে ভোট না পেলেও লোকসভায় বহরমপুরবাসী বরাবর ভরসা রেখেছিলেন অধীরের উপর। সেই ১৯৯৬ সালের বিধানসভা ভোটে নবগ্রাম আসন থেকে জিতে বিধায়ক হয়েছিলেন অধীর। এরপর আর তাঁর বিজয়রথ থামেনি। বলা হয়, বঙ্গ রাজনীতির লম্বা রেসের ঘোঁড়া হলেন অধীর। পরপর পাঁচবার তিনি জিতে লোকসভায় গিয়েছেন। শেষবার তিনিই ছিলেন লোকসভার বিরোধী দলনেতা। সেই অধীরের জয়রথ এবার থামলো, প্রথমবার ভোটে দাঁড়ানো ইউসুফ পাঠানের কাছে। রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহল বলছে, ইউসুফের মতো তারকা প্রার্থী, তৃণমূলের দক্ষ সংগঠন এবং বিজেপির জনপ্রিয় চিকিৎসক প্রার্থী নির্মল চন্দ্র সাহার ত্রিমুখী চাপেই এবার ধরাশায়ী হল অধীরের দূর্গ।
Discussion about this post