ভারতের উত্তরপ্রান্তে অবস্থিত জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের বেশিরভাগ এলাকাতেই শীতকালে তাপমাত্রা মাইনাসের নীচে নেমে যায়। বিশেষ করে পাক সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে। এরমধ্যে দ্রাস পৃথিবীর দ্বিতীয় শীতলতম স্থান, যেখানে মানুষ বসবাস করেন। এই দ্রাস, বাটালিক, কার্গিলের গা ঘেষে চলে গিয়েছে এলওসি বা লাইন অফ কন্ট্রোল। যা ভারত এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরকে আলাদা করেছে। ভারতের সার্বভৌমত্ব রক্ষার কৌশলগত দিক থেকে এই এলাকাগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে পাকিস্তান সেনা এবং তাঁদের ছত্রছায়ায় পালিত জঙ্গি সংগঠনগুলি বরাবারই টার্গেট করে এই এলাকাগুলিকে। যেমনটা করেছিল ১৯৯৯ সালের মে মাসে। প্রবল শীতেও পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিরা নিয়ন্ত্রণরেখা পার করে মুশকো, দ্রাস, কাকসার, বাটালিক, কার্গিলের একাধিক পয়েন্টে ঘাঁটি গেড়ে ভারতের কয়েকটি বাঙ্কার দখল করে বসেছিল। জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত এই এলাকায় এতটাই বরফ পড়ে যে সেই বাঙ্কারগুলি কার্যত অরক্ষিত থাকতো। ফলে সেগুলি সহজেই দখল করে রেথেছিল জঙ্গিরা। এই খবর পাওয়ার পরই অভিযান শুরু করে ভারতীয় সেনা। সেই অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন বিজয়’। কিন্তু পরে তা পুরদস্তুর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পরিনত হয়।
১৯৯৯ সালের ৩ মে শুরু হয়ে ২৬ জুলাই পর্যন্ত চলেছিল কার্গিল যুদ্ধ। প্রায় তিন মাস ধরে চলা এই যুদ্ধ আজও সামরিক বিশেষজ্ঞদের কাছে এক গবেষণার বিষয়বস্তু হয়ে রয়েছে। কারণ এই যুদ্ধ বিভিন্ন কারণে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। ভারত এবং পাকিস্তান দুই প্রতিবেশী অথচ পরমানু শক্তিধর দেশের যুদ্ধ। যা নিয়ে উদ্বেগে পড়েছিল গোটা বিশ্ব। আবার ভৌগলিক এবং কৌশলগত কারণেও কার্গিল যুদ্ধ সামরিক ছাত্রদের কাছে অপরিহার্য বিষয়। আজ ২৫ বছর পরও তাই কার্গিল যুদ্ধ বা অপারেশন বিজয়ের গুরুত্ব কোনও অংশে কমেনি।
কার্গিল যুদ্ধে ভারতীয় সেনার প্রায় ৫০০ জনেরও বেশি জওয়ান শহীদ হয়েছিলেন। যা যথেষ্ট বেদনা দিয়েছিল দেশবাসীকে। কিন্তু প্রথমদিকে পাকিস্তান দাবি করে আসছিল, জঙ্গিরাই অনুপ্রবেশ করেছে, পাক সেনার কোনও ভূমিকা নেই। কিন্তু ভারতীয় জওয়ানদের সাহসিকতার কাছে পাকিস্তানের সেই ছলনা ধরা পরে যায়। ফলে পাকিস্তানকে স্বীকার করতে হয় পাক রেঞ্জার্সরও ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকেছে। ফলে ভারত যুদ্ধ ঘোষণা করলেও আন্তর্জাতিক মহলে চাপে পড়ে পাকিস্তানই। পরবর্তী সময়, পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাপ্রধান তথা প্রাক্তন পাক রাষ্ট্রপতি জেনারেল পারভেজ মুশারফ তাঁর আত্মজীবনী “ইন দ্য লাইফ অফ ফায়ার” বইয়ে স্বীকার করেছিলেন অনুপ্রবেশকারীদের দলে পাক সেনাও ছিল। আসলে সেই সময় পাকিস্তানের শাসক এবং সেনাবাহিনী ভেবে নিয়েছিলেন, আমেরিকা-সহ আন্তর্জাতিক মহল এই যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করবে। এবং লাভের গুড় আসবে পাকিস্তানের কাছে। এই ফাঁকে কাশ্মীর পাকিস্তানের দখলে চলে আসবে। কিন্তু বাধ সেধেছিল ভারতীয় সেনা। মাত্র তিন মাসের মধ্যেই দখলদারদের হটিয়ে সব পয়েন্টের দখল নিয়ে নেয় ভারতীয় সেনা। ফলে আন্তর্জাতিক মহল নাক গলানোর আগেই পাক বাহিনী শায়েস্তা হয়ে গিয়েছিল। ভারত ১৯৯৯ সালের ২৬ জুলাই অপারেশন বিজয়ের সমাপ্তি ঘোষণা করে এবং ওই দিনটি বিজয় দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ভারত ও পাকিস্তান পরমানু শক্তিধর দেশ হওয়ার পরও কার্গিল যুদ্ধে তা ব্যবহার করেনি কোনও দেশই। তবে সেই সময় আন্তর্জাতিক মহলে গুঞ্জন উঠেছিল, বিবদমান দুই দেশই পরমাণু হামলা চালাতে উদ্যোগী। পাক সংবাদমাধ্যমও দাবি করেছিল, পাকিস্তান সেনা পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে বধ্যপরিকর। কিন্তু জানা যায়, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন নাকি পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করা থেকে বিরত করেছিলেন। পরবর্তী সময় নওয়াজ শরিফও এই দাবি মেনে নিয়েছিলেন। কার্গিল যুদ্ধে, আমেরিকা-সহ কয়েকটি প্রথমসারির দেশ নাক গলালেও এই সময় আশ্চর্যজনকভাবে নিরব ছিল চিন। বরাবরই ভারতের সঙ্গে আড়াআড়ি সম্পর্ক রেখে চলা চিন পাকিস্তানের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে পরিচিত কূটনৈতিক মহলে। কিন্তু কার্গিল যুদ্ধের সময় না পাকিস্তান, না ভারতের পক্ষ নিয়েছিল বেজিং। জানা যায়, চিন সেসময় জিনিজয়াংয়ের ইসলামি আন্দোলনকে দমন করতে ব্যস্ত ছিল। সেই সময় চিনে ইউঘুরু মুসলমানরা কমিউনিস্ট শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। সেই বিদ্রোহ দমন করতে ব্যস্ত চিনা শাসকরা ভারত-পাক যুদ্ধ নিয়ে নাক গলায়নি। ফলে আমেরিকা হোক বা চিন, পাকিস্তান কারও সাহায্য পায়নি সেসময়। অপরদিকে ভারতীয় সেনার অপার শৌর্য এবং সাহসিকতা জয়পতাকা তুলে ধরতে সাহায্য করেছিল ভারতকে। আজ সেই কার্গিল বিজয় দিবসের রজতজয়ন্তী বর্ষ। নিউজ বর্তমান সমস্ত কার্গিল শহীদদের গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপণ করে।
Discussion about this post