চাকরি হারিয়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন শিক্ষকরা। যদিও তাদের কপালে জুটেছিল লাঠিপেটা ও ভারী বুটের লাথি। তবুও সেই শিক্ষকরা পুলিশকে শেখালেন নৈতিকতার পাঠ। তাদের হাতে তুলে দিলেন গোলাপ ফুল। তাঁরা ভবিষ্যতের নাগরিক গড়ার কারিগর। তাঁদের দেওয়া শিক্ষায় কেউ হন ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বা পুলিশ। আজ সেই শিক্ষকদের একটা বড় অংশ বিপন্ন। যারা প্রকৃত মেধাবী ও যোগ্য হয়েও আজ চাকরিহারা। সঙ্গত কারণেই তাঁরা রাস্তায় নেমে এসেছেন এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। অথচ চাকরিহারা সেই শিক্ষকদের ওপর নির্মম লাঠিচার্জ করলো কলকাতা পুলিশ। তাতেও তৃপ্তি মেটেনি কিছু পুলিশ আধিকারিকের, তাঁরা আন্দোলনরত শিক্ষকদের পেটে লাথি মারতে ছাড়লেন না। কিন্তু তারা শিক্ষক খুদে পড়ুয়াদের প্রকৃত শিক্ষা দিয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে যারা সাহায্য করেন তারা বুঝিয়ে দিলেন আন্দোলনের প্রকৃত ভাষা। তাই লাঠি ও লাথি খেয়েও আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষিকারা গোলাপ হাতে এগিয়ে গেলেন পুলিশকর্মীদের দিকে। প্রত্যেকের দিকে এগিয়ে দিলেন একটি গোলাপ। তখন বিব্রত পুলিশকর্মীদের অবস্থা ঠিক যেন ছুঁচো গেলার মতো। কি করবেন বুঝতে পারছেন না। কেউ কেউ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন, কেউ আবার মুখ লুকোতে ব্যস্ত। এই চিত্র শুধুমাত্র শহর কলকাতার নয়, বরং মেদিনীপুর, বাঁকুড়া বা বর্ধমান, রাজ্যের সর্বত্রই দেখা গেল। কোথাও চাকরিহারা শিক্ষকদের বুকে ঝোলানো প্ল্যাকার্ড, তাতে লেখা ‘ছাতি দিলাম, লাথি মারো’।
রাজ্যের প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকদের চাকরি গিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে। যদিও এই একই রায় এক বছর আগে কলকাতা হাইকোর্ট দিয়েছিলো। যোগ্য ও অযোগ্যদের আলাদা করা যায়নি, তাই পুরো প্যানেল বাতিল। এখানেই মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষকদের প্রশ্ন, রাজ্য সরকার, এসএসসি এতদিন কি করলো? কেন আলাদা করা গেল না? কেন ওএমআর শিট নষ্ট করে দেওয়া হল, কেনই বা ডিজিটাল ডেটা সংরক্ষিত হল না? মিরর ইমেজই বা কই? বিরোধীদের বক্তব্য, দুর্নীতি ঢাকতেই এই সমস্ত তথ্য প্রমান দ্রুত লোপাট করা হয়েছে।
রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য নিজের মতো করে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে ময়দানে নেমেছেন। আর জি কর কাণ্ডের জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলনের সময় তিনি যেমন বাম ও বিজেপিকে খুঁজে পেয়েছিলেন, এবারও তাঁর আবিষ্কার সেই বাম ও বিজেপি। তাঁর পরিষ্কার বক্তব্য, আমি চাকরি দিয়েছি, আর ওরা চাকরি খেয়েছে। কিন্তু তিনি ভুলে যাচ্ছেন, যাদের এই গল্প শোনাচ্ছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই উচ্চ শিক্ষিত ও সমঝদার। ফলে দুধ ও জলের তফাৎ তাঁরা করতে জানেন। ফলে যথারীতি চিরে ভেজেনি। আন্দোলন চলছে চাকরিহারা শিক্ষকদের। শিক্ষমন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সঙ্গেও বৈঠক হল চাকরিহারা শিক্ষকদের, ফলাফল শূন্য। আসলে তৃণমূল চাইছে চাকরিহারা শিক্ষকদের বিভ্রান্ত করে তাঁদের দ্বিধাবিভক্ত করতে। তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজনের দড়ি টেনে সমাজের কাছে ছোট করতে। এটাই মুখ্যমন্ত্রীর পরিকল্পনা। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে পুনরায় আবেদন করে বিষয়টি আরও দীর্ঘস্থায়ী করে চাকরিহারাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিতে। তাই কখনও পুলিশ দিয়ে লাঠিপেটা করে, কখনও আবার আলোচনার টেবিলে ডেকে গরমে-নরমে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু শিক্ষকরা জানেন প্রতিবাদের ভাষা কি হওয়া উচিত। তাই তাঁরা পুলিশকর্মীদের দিকে গোলাপ ফুল এগিয়ে দিলেন। বিব্রত পুলিশ কর্মীরা কিছুক্ষণ ভাবার পরে ফুলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন বটে, তবে তাঁদের শুনতে হল নৈতিকতার পাঠ। পুলিশকে শিক্ষকেরা বলেন, ‘আপনাদের পুলিশ বন্ধুরা আমাদের শিক্ষকদের পেটে লাথি মারলেও আমরা আপনাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করব না। কারণ আপনারাও একদিন ছাত্র ছিলেন। আপনাদের ছেলেমেয়েরা অনেকেই হয়তো আমাদের ছাত্রছাত্রী। আমরা যদি খারাপ ব্যবহার করি, আপনাদের ছেলেমেয়েদের কী শেখাব?’
Discussion about this post