ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট ক্ষমতায় এসেছে ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে এমন একটা সময়ে, যখন দীর্ঘ স্বৈরশাসনে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসপ্রায়, আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় লুণ্ঠনে অর্থনীতিও বিপর্যস্ত। অন্যদিকে হাসিনার ক্ষমতা অবসানের পর মানুষের মধ্যে জেগে উঠেছে রাষ্ট্র সংস্কার ও অর্থনীতি পুনর্গঠন করে একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের ব্যাপারে বিপুল আশা ও উদ্দীপনা। অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধি হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা তাই অনেক, যা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সভা-সেমিনার, মিছিল-সমাবেশ, সংবাদমাধ্যমে লেখালেখি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আলোচনার মধ্য দিয়ে উঠে আসছে। অন্তর্বর্তী সরকার দেশের মানুষের এই বিপুল প্রত্যাশা পূরণ করতে কতটা সক্ষম? সম্প্রতি ক্ষমতায় থেকে ১০০ দিন পূরণ করেছে ইউনূস সরকার। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে খামতি রয়েই গিয়েছে এই সরকারের। যেমন, সরকার গণ-অভ্যুত্থানের সময় আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার সব ধরনের দায়িত্ব নেওয়ার ঘোষণা দিলেও তা বাস্তবায়নে সমস্যা রয়ে গেছে। এখনো অর্থের অভাবে অনেকে চিকিৎসা করাতে পারছেন না বলে খবর রয়েছে। জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া সুনির্দিষ্ট করে হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারী ও হুকুমের আসামিদের শনাক্ত করা, গ্রেপ্তার ও বিচার করার প্রক্রিয়া দৃশ্যমান হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে যাঁদের বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাঁদের অপরাধের ধরনের সঙ্গে সম্পর্কহীন ঢালাও মামলা দেওয়া হচ্ছে, যেগুলোর আদালতে টেকার সম্ভাবনা কম। চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে চাহিদা অনুযায়ী বাজারে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা, বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া ও বিকল্প ব্যবস্থায় সীমিত আয়ের মানুষের কাছে অপেক্ষাকৃত কম দামে নিত্যপণ্য সরবরাহ করার তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। সচিবালয়সহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এক দলের বদলে অন্য দলের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে, ঢালাও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, এর ফলে যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, এমন কর্মকর্তারাও বঞ্চিত হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। এছাড়াও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক করা যায়নি, পুলিশ বিভাগ পুরোপুরি কার্যকর হয়নি, যত্রতত্র মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সরকারি হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জোরপূর্বক পদত্যাগ করানোর ঘটনা ঘটে চলেছে, প্রতিষ্ঠানগুলো সেবামূলক কাজ ঠিকঠাক করতে পারছে না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন মানদণ্ড ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে, তা পরিষ্কার করা হয়নি। এতে অনেক ক্ষেত্রে যোগ্যতাসম্পন্ন নিয়োগ হলেও দলীয় বিবেচনায় প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগের অভিযোগ রয়ে গেছে। দাগি ও শীর্ষ সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত বেশ কয়েকজন অপরাধীকে একের পর এক জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ঠিক কোনো মানদণ্ড বা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটেছে, তা স্পষ্ট নয়। অর্থাৎ বাংলাদেশে জঙ্গিদের বারবারান্ত প্রশ্রয় দিচ্ছে ইউনুস। পুলিশ, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ইত্যাদির সংস্কারের কথা বললেও এগুলো সংস্কারের পদ্ধতিগত দিক স্পষ্ট করা হয়নি, কোনো টাইমলাইন ও রোডম্যাপও ঘোষণা করা হয়নি। অতীতে দেখা গেছে, একটি স্বৈরাচারী ব্যবস্থা উচ্ছেদ করলেও আবার অন্য একটি স্বৈরাচারী ব্যবস্থা বাংলাদেশের ওপর জেঁকে বসেছে। সাধারণ মানুষ যে উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নিয়ে সরকার পরিবর্তন করে তা আর অর্জিত হয় না।বিশেষ করে অর্থনীতির ভিত্তিটা কী তার ওপর সরকারের আচরণ অনেকটাই নির্ভর করে। দুর্বৃত্তায়িত অর্থনীতি বিদ্যমান থাকলে তার ওপর দাঁড়িয়ে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি তৈরি হয়। আর দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতিকে পাহারা দিতে একটি সরকারকে স্বৈরাচারী হতে হয়। ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম স্লোগান ছিল—বৈষম্য মুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা। কাজেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে সমাজের সবস্তরে বিদ্যমান বৈষম্য যথাসম্ভব দূর করা। এ লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিছু সংস্কারের রূপরেখা প্রণয়ন করবে এবং সুপারিশ প্রদান করবে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই সুপারিশগুলো গ্রহণ করা গেলে, আগামী সরকারকে বা সরকারের বাইরে থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীকে ওই সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করাতে প্রচেষ্টা নেওয়া যাবে। অন্যদিকে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত বেশ কয়েকটি ‘সংস্কার কমিশন’ বেশ কিছু নতুন প্রস্তাব নিয়ে কাজ শুরু করেছে। এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন ও পুলিশ সংস্কারে বড়সড় পরিবর্তন আনার কথা ভাবছে কমিশনগুলো। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্র সংস্কারে মোট দশটি কমিশন গঠন করা হলেও এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে সংবিধান ও নির্বাচনী সংস্কারের বিষয়গুলো।
গত বছর শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের নতুন রসায়ন খুবই মধুর হতে শুরু করেছে। প্রায় ৫০...
Read more
Discussion about this post