কি আশ্চর্য সমাপতন! সেই ২০০০ সালে রাজ্যে তখন ভরা বাম শাসন। রাজ্যের প্রধান বিরোধী নেত্রী তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সময় বাংলার অধিকাংশ এলাকা ডুবে গিয়েছিল জলের তলায়। প্রবল বন্যায় ডুবেছিল শহর থেকে গ্রাম। তখনই প্রথম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার রাজনীতিতে নিয়ে এসেছিলেন একটি তত্ত্ব। সেটা হল “ম্যান মেড বন্যা”। সেবার রাজ্যের শাসকদল তথা মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে আক্রমণ করতে তৃণমূল সুপ্রিমো হাজির করেছিলেন ম্যান মেড বন্যার অদ্ভুত তত্ত্ব। এরপর রাজ্যে পালা বদলের পর তাঁর ভূমিকা বদলেছে। এথন তিনিই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, আর এখনও তাঁর মুখে “ম্যান মেড বন্যা” তত্ত্ব। বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন সরকারকে বিঁধতে যে তত্ত্ব তিনি খাঁড়া করেছিলেন, আজ মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি সেই তত্ত্ব খাঁড়া করছেন। এখানে সরকারের ভূমিকা বদলে গিয়েছে। তখন তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য ছিল রাজ্যের বাম সরকার, এখন তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। এমনকি তিনি পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ডকেও এর জন্য দায়ি করে বসেছেন।
সেই অর্থে ম্যান মেড বন্যা শব্দবন্ধটির ২৪ বছর পূর্ণ হল। যতই তাঁর ভূমিকা বদল হোক ততই এই শব্দবন্ধ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে শোনা যায় ঘুরে ফিরে। এবার তিনি কাঠগড়ায় তুললেন কেন্দ্রীয় সংস্থা দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন বা ডিভিসিকে। বৃহস্পতিবার সকালে পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ায় প্লাবিত এলাকা পরিদর্শনে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বন্যা কবলিত এলাকায় দাঁড়িয়েই তাঁর তোপ, এটা ঝাড়খণ্ড জল ছেড়েছে, ডিভিসি কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা, চার লক্ষ কিউসেক জল ছেড়েছে। যা কোনওদিন হয়নি। তাঁর আরও দাবি, ডিভিসি-র জলধারণ ক্ষমতা এখন মাত্র ৩৬ শতাংশ এসেছে। ডিভিসি-র জলে কেন বাংলা ডুববে? আমরা কৈফিয়ত চাই। ফরাক্কা ড্রেজিং করে না, বাংলা ডোবে, বিহার ডোবে। আর ডিভিসি ড্রেজিং করে না, বাংলা ডোবে। ঝাড়খণ্ডকে বাঁচানোর জন্য জল ছাড়া হয়। ডিভিসি-র সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখব কিনা, ভেবে দেখব। মুখ্যমন্ত্রী এদিন দাবি করেছেন, আমরা ৫ লক্ষ পুকুর কেটেছি, ৫০০ চেক ড্যাম করেছি। তবুও দোতলা সমান জল ঢুকছে। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়েও এদিন কেন্দ্রীয় সরকারকে দূষে মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন, ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান, যেটা পড়ে রয়েছে ১০ বছর ধরে, সেটাও আমরা বিপিআর তৈরি করছি। আগামী ২ বছরের মধ্যে করে দেব। পাশাপাশি বন্যা দুর্গতদের সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, “আপনাদের যা সাহায্য করার, করা হবে”।
রাজনৈতিক মহলের প্রশ্ন, ডিভিসিকে কাঠগড়ায় তুলতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এদিন আক্রমণ করলেন ঝাড়খণ্ডকেও। অথচ, চলতি বছরে নীতি আয়োগের বৈঠকে বিরোধী শিবিরের মধ্যে তিনিই একমাত্র যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে মোদি সরকারের নীতির বিরোধীতা করে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন যোগ দেননি। ওয়াকিবহাল মহলের প্রশ্ন, বন্যা নিয়ে কেন্দ্রকে তোপ দাগতে গিয়ে তিনি বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে দিলেন না তো? উল্লেখ্য, গত কয়েকদিন নিম্নচাপের জেরে লাগাতার বর্ষণে নদীগুলিতে জল বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। ফলে মাইথন, পাঞ্চেত বাঁধের উপর চাপ বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে মাইথন থেকে ১০ হাজার এবং পাঞ্চেত থেকে ৭০ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে বৃহস্পতিবারই। যদিও গত সোমবার থেকেই ডিভিসি ধাপে ধাপে জল ছেড়েছে মাইথন এবং পাঞ্চেত জলাধার থেকে। এর জেরেই পূর্ব বর্ধমান, হুগলি, হাওড়ার বিস্তৃর্ণ অঞ্চল জলের তলায় চলে গিয়েছে। এর পরই মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্র এবং ডিভিসির উপর দায় চাপিয়ে তোপ দেগে দিলেন, পরিকল্পিত ভাবেই বাংলাকে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর তাঁর মুখে ফের শোনা গেল বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ম্যান মেড বন্যা তত্ত্ব। যা তিনি প্রথম বলেছিলেন সেই ২৪ বছর আগে তৎকালীন বাম সরকারকে তোপ দাগতে গিয়ে।
Discussion about this post