সারা পৃথিবীর মানুষ জগদ্ধাত্রী পুজো বলতে চন্দননগরের পুজোই বোঝেন। অনেকেই মনে করেন, হুগলির চন্দননগরেই সূচনা হয়েছিল জগদ্ধাত্রী পুজোর। আবার নদিয়ার কৃষ্ণনগরেও প্রাচীন কয়েকটি জগদ্ধাত্রী পুজো হয়। কেউ কেউ দাবি করেন এখানেই রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের হাত ধরে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু হয়েছিল এই বাংলায়। কিন্তু ইতিহাস বলছে অন্য কথা, কৃষ্ণনগর বা চন্দননগরে মোটেই জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা হয়নি। হয়েছিল অন্য এক শহরে। এবং একটি গাছতলায়। সেই ইতিহাস শুনলে আপনিও চমৎকৃত হতে বাধ্য।
নদীয়া জেলার শান্তিপুর অতি প্রাচীন এক জনপদ। এই শহর যেমন বৈষ্ণবদের কাছে অতি পবিত্র, তেমনই শক্তির উপাসকদের কাছেও জনপ্রিয়। শান্তিপুরের হরিপুর গ্রামে থাকতেন চন্দ্রচূড় তর্কমুনি নামে এক তন্ত্রসাধক। রাজা গিরিশচন্দ্র রায় যখন ১৮০২ সালে নদিয়ার রাজত্ব করছেন। শান্তিপুরের হরিপুরে তখন ১০৮ ঘর ব্রাহ্মণের বাস ছিল। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন চন্দ্রচূড় তর্কমুনি। ইতিহাস বলছে, সেই সময় রাজার পৃষ্টপোষকতায় কোনও এক ঊষাকালে প্রথম বার জগদ্ধাত্রীর মূর্তি গড়ে স্থাপন করেছিলেন এক কামরাঙা গাছের নীচে পঞ্চমূণ্ডির আসনে। সেখানেই প্রথমবার পূজিতা হয়েছিলেন দেবী জগদ্ধাত্রী। কথিত আছে, এর পর থেকেই কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজো চালু হয়।
এই বাংলায় জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা নিয়ে যে কাহিনী বহুল প্রচলিত তার সঙ্গে জড়িত কৃষ্ণনগরের জনপ্রিয় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাম। কিংবদন্তি, তখন নবাব আলিবর্দির রাজত্বকাল, সে সময়ে একবার কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে ১২ লক্ষ টাকা নজরানা দাবি করেন নবাব। রাজা সেই বিপুল পরিমান অর্থ দিতে অপারগ। ফলস্বরূপ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে বন্দি করে মুর্শিদাবাদ নিয়ে যাওয়া হয়। যদিও পরে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। মুক্তির পর নদীপথে কৃষ্ণনগরে ফিরছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। কথিত আছে, সে দিনটা ছিল বিজয়া দশমী। ঘাটে ঘাটে চলছে দূর্গাপ্রতিমা নিরঞ্জনের পর্ব, আকাশে বাতাসে ভাসছে দেবী বিদায়ের ঢাকের বাদ্য। বিসর্জনের বাজনা শুনে রাজা বুঝতে পারেন সেই বছর দুর্গাপুজোর কাল উত্তীর্ণ।
দুর্গাপুজোর আয়োজন করতে না পেরে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে পড়েন। সেই রাতেই দুর্গা জগদ্ধাত্রীর রূপে রাজাকে দেখা দেন এবং বলেন, পরবর্তী শুক্লানবমী তিথিতে তাঁকে পুজো করার। সেই থেকেই কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা। অনেকটা পরে, রাজবাড়ির দেখাদেখি কৃষ্ণনগরে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রজারাও জগদ্ধাত্রী পূজা শুরু করেন। কৃষ্ণনগর চাষাপাড়ায় যে পুজোটি শুরু হয়, তা বুড়িমার পুজো নামে পরিচিত। এটাই প্রথম বারোয়ারী পুজো। প্রথম দিকে গোয়ালারা দুধ বিক্রি করে এই পুজোর আয়োজন করতেন। পরবর্তীকালে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের জগদ্ধাত্রী পুজো দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ফরাসিদের দেওয়ান ইন্দ্র নারায়ন চৌধুরী তৎকালীন ফরাজডাঙ্গা অর্থাৎ আজকের চন্দননগরে প্রথম জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেছিলেন।
Discussion about this post