গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। মূলত বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গণ অভ্যুত্থান সংগঠিত হয় বাংলাদেশে। তাতে যেমন ছাত্রদের ভূমিকা ছিল, তেমনই বিএনপি-জামাতের মতো প্রথমসারির আওয়ামী লিগের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকাও ছিল। কিন্তু হাসিনা পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে আন্দোলনাকরী ছাত্র মঞ্চের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। যেমন সে সময় দাবি করা হয়েছিল, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসকে রাজি করিয়ে ছাত্ররাই প্রধান উপদেষ্টা করেছেন। আবার উপদেষ্টা মণ্ডলীতে তাঁদের যেমন প্রতিনিধি রয়েছে, তেমনই তাঁদের পছন্দের শিক্ষক, অধ্যাপক বা সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিরা ঠাঁই পেয়েছেন। তবে বিএনপি বা জামাতের মতো দলগুলিও অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করছিল। যা ইউনূস সরকার গঠনের প্রথম দুই-আড়াই মাস পর্যন্ত অটুট ছিল।
কিন্তু ইদানিং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকটি সিদ্ধান্ত এবং বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বের কয়েকটি দাবিদাওয়া নিয়ে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে খালেদা জিয়ার দলের সঙ্গে। এমনকি জামাতের মতো দলও এই ছাত্রনেতাদের দাবির সঙ্গে একমত হতে পারেনি। যা নিয়ে নতুন করে চর্চা শুরু হয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে। বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দল বিএনপি আগেই দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু তা নিয়ে গড়িমসি করছে ইউনূসের নেতৃত্বাধীন তদারকি সরকার। এবার এই ইস্যুতে তদারকি সরকারকে সরাসরি নিশানা করতে ছাড়ছে না বিএনপি। আবার রাষ্ট্রপতির অপসারণের দাবিকেও সরাসরি নস্যাৎ করেছে বিএনপি। আবার ইউনূস প্রশাসনের তরফে আওয়ামী লিগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পরিকল্পনা নিয়েও দ্বিমত পোষণ করেছে বিএনপি। সব শেষে আসছে বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করার সিদ্ধান্ত। যা নিয়ে সরাসরি বিরোধের মুখে পড়েছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি। কিন্তু কেন এই বিরোধ? তবে কি দুই সংগঠনের মধ্যে ফাটল দেখা দিচ্ছে?
আসলে বাংলাদেশের সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান লেখা এবং রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে রাজনৈতিক বিরোধীতার মুখে পড়েছে গণ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। আবার আওয়ামী লিগকে নিষিদ্ধ করার যে দাবি ও পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে সেটা নিয়েও নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে বিএনপি। যা ছাত্রদের পক্ষে যাচ্ছে না। ফলে একটা ফাটলের চিত্র ধরা পড়ছে। যদিও খালেদা জিয়ার দল বিএনপি পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছে, সাংবিধানিক সংকট যাতে তৈরি না হয় সে কারণেই এই দাবিগুলি মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই এই রাষ্ট্রপতির অপসারণে তাঁদের সায় নেই। আবার সংবিধান বদলের বিষয়েও নির্বাচিত একটা সরকার প্রয়োজন হয়। যদিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি বিএনপি বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে বিএনপির অবস্থান জানার পর তাঁদের বক্তব্য, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বিএনপি এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তাই ধারাবাহিক আলোচনা হলেও ঐক্যমতে আসা যাচ্ছে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, এটা অবশ্য দূরত্ব বা ফাটল বলা ঠিক হবে না। আমরা ছাত্রদের বোঝানোর চেষ্টা করছি, যে এভাবে রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন হলে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি হবে। যা মোকাবিলা করা অসম্ভব। অপরদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল দাবি করেছেন, হয়তো বিএনপি ভাবছে এখন রাষ্ট্রপতি অপসারিত হলে আগামীদিনে নির্বাচন পিছিয়ে যাবে। কিন্তু মুহাম্মদ ইউনূসের তদারকি সরকারের যা মনোভাব তাতে আদৌ জলদি নির্বাচন করা হবে না এটা পরিস্কার। ফলে বিএনপি বা জামাতের মতো রাজনৈতিক দল এখন জল মাপতে শুরু করেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) হাফিজউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘‘এই সরকারের প্রধান কাজ হল একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। কিন্তু দেখা গেল, যে যায় লঙ্কায়, সে–ই হয় রাবণ। তারা বোধ হয় হয় দীর্ঘদিন, ১০-২০ বছর ক্ষমতায় থাকতে চায়’’। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি চায় দ্রুত নির্বাচন। সংস্কার বা রাষ্ট্রপতি পরিবার্তন নিয়ে তাঁদের মাথাব্যাথা কম। অন্যদিকে রাজনৈতিক মহলের একাংশ আবার ইউনূস প্রশাসনের এক্তিয়ার নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। যা আগামীদিনে বাংলাদেশে নতুন করে সংকট তৈরি করতে পারে। ফলে পালাবদলের পর ধীরে ধীরে বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসক এবং রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে মতবিরোধ আরও বড় আকার নিতে চলেছে, এ কথা বলাই যায়।
Discussion about this post