নবদ্বীপ ও শান্তিপুরের রাস উৎসব কিন্তু জগৎ বিখ্যাত। এই রাস উৎসব হল মূলত বৈষ্ণব ও শাক্ত মতের মিলন। জানা যায় প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে এই উৎসবের সূচনা হয়েছিল। নদিয়া জেলা যেমন বৈষ্ণবদের লীলাক্ষেত্র, তেমনই শাক্ত সাধকদেরও। নদিয়ার নবদ্বীপের রাস উৎসবের মূল আকর্ষণ বিভিন্ন দেবদেবীর বিগ্রহ এবং তাঁদের সাজসজ্জা। রাস উৎসবে কেবল রাধারানিই নন, পূজিত হন অন্যান্য দেবদেবীরাও। মূলত তিনটি ধাপে পালিত হয় এই রাস উৎসব। প্রথম রাস, দ্বিতীয় রাস ও ভাঙা রাস। এগুলির মধ্যে অন্যতম ভাঙা রাসের শোভাযাত্রা। কথিত আছে, ১৭৫২-৫৬ সালের মাঝামাঝি শঙ্করনাথ তর্কবাগীশ শক্তিমূর্তি গড়ে রাস পূর্ণিমার পুজো শুরু করেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের তরফে আসে অর্থসাহায্য। আবার এও মনে করা হয়, শ্রীচৈতন্যদেব রাধাকৃষ্ণের রাস উৎসব সূচনা করেছিলেন নদীয়ার নবদ্বীপে। তবে যত দিন যাচ্ছে, ততই নবদ্বীপের রাসে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্য। তার জায়গায় দেখা যাচ্ছে থিমের বাহুল্য।
দুর্গাপুজো, কালীপুজো, জগদ্ধাত্রী পুজোর শেষে এবার নদিয়া জেলার নবদ্বীপ শহর সেজে উঠেছে রাস উৎসবের আলোয়। গোটা শহর যেন নববধূঁর সাজে সজ্জিত। দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীদের ভিড় শুরু হয়ে গিয়েছে। নবদ্বীপ রাসের প্রধান বিশেষত্ব হচ্ছে এখানকার মূর্তির বিশালতা। অপরূপ সব মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করে নানা রূপে শক্তি আরাধনায় মাতেন নবদ্বীপবাসী। এটিই রাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তবে এ বছর থিমের চাকচিক্যে ঢাকছে রাসের ঐতিহ্য। চিরাচরিত উচ্চতার ঐতিহ্য ছেড়ে থিমের দিকে ঝুকছে নবদ্বীপের বারোয়ারী পুজো কমিটিগুলি। এখানে একদিকে যেমন রাধাকৃষ্ণের মূর্তি, শ্রীচৈতন্য, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর বিভিন্ন রূপের মূর্তি থাকে, তেমনই শাক্তমতে কালী, দূর্গা, চণ্ডী, নৃসিংহদেবের মতো অসংখ্য হিন্দু দেবতার পুজো হয় একই সঙ্গে।
নবদ্বীপের মূল ঐতিহ্য এই বিশালাকায় মূর্তি গড়ে বিভিন্ন দেবদেবীর আরাধনা। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরেই নবদ্বীপে থিমের বাহুল্য বেড়েছে। কলকাতার মতো মণ্ডপ, আলোর বাহার দেখা যাচ্ছে। মণ্ডপ নির্মানেও থিমের প্রাবল্য থাকছে। নবদ্বীপের কেন্দ্রীয় রাস উৎসব কমিটির তরফে বলা হচ্ছে, এখানকার রাসের মূল আকর্ষণ হল আড়ং বা শোভাযাত্রা। সকাল ও সন্ধ্যা মিলিয়ে শোভাযাত্রা বের হয় নবদ্বীপে। তবে এবার সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করার জন্য এই শোভাযাত্রায় কিছুটা কড়াকড়ি করা হচ্ছে। নবদ্বীপে ২১৪টি বারোয়ারী রাস উৎসবে অংশগ্রহন করে। এরমধ্যে ১৮০টি বারোয়ারী শোভাযাত্রায় অংশ নেয়। তবে মূল আকর্ষণ সাতটি বারোয়ায়ীর শোভাযাত্রা। এ বছর রাসের শোভাযাত্রা হবে ১৬ অক্টোবর, শনিবার। এক সময়ে রাস মানে ছিল পূর্ণিমার ভরা রাতে বিশুদ্ধ তন্ত্রমতে শক্তির আরাধনা। বিভিন্ন মূর্তির সারম্বর পুজো। কোন বারোয়ারীর কত বড় প্রতিমা তা নিয়ে চলত সুষ্ঠ প্রতিযোগিতা। তবে এ বছর সেই প্রথা ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন নবদ্বীপের একাধিক ক্লাব ও বারোয়ারি পুজো কমিটি। বিশালাকায় মূর্তি ছেড়ে থিমের চাকচিক্যে চমক দিতে চাইছে ঐতিহ্যের নবদ্বীপ।
Discussion about this post