গত বছরের ৯ আগস্ট, সেই অভিসপ্ত দিনে কলকাতার নামী মেডিকেল কলেজের সেমিনার রুমে পাওয়া গেল কর্তব্যরত এক মহিলা চিকিৎসকের দেহ। এরপরের ঘটনা এখন গোটা ভারতবাসী জানেন। ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই কলকাতা পুলিশ গ্রেফতার করে তাঁদেরই এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে। যার নাম সঞ্জয় রায়। পরে ১৩ আগস্ট কলকাতা হাইকোর্ট আর জি কর ধর্ষণ ও খুনের মামলার তদন্তভার কলকাতা পুলিশের হাত থেকে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইকে দেয়। পরের কয়েকমাস ধরে তদন্ত চালিয়েও সিবিআই একা সঞ্জয়কেই দোষী হিসেবে দায়ী করে। আর জি কর হাসপাতালের মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় কলকাতা পুলিশের সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়ের নামেই চার্জ গঠন করে সিবিআই। শুনানির শেষে ১৮ জানুয়ারি রায়ও ঘোষণা করে দিয়েছে শিয়ালদা আদালত। ২০ জানুয়ারি, সোমবার সাজাও ঘোষণা করে দিলেন বিচারক। সাজা ঘোষণা করে বিচারক সঞ্জয়ের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘‘আপনাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জেলে থাকতে হবে”। বিচারক এই ঘটনাকে বিরলের মধ্যে বিরলতম বলতে নারাজ। বহু প্রশ্নের উত্তর বাকি রেখেই আর জি কর মামলার প্রথম সাজা ঘোষণা হয়ে গেল সোমবার।
২০২৪ সালের সবচেয়ে সাড়া জাগানো ঘটনা, আর জি কর ধর্ষণ ও খুন মামলার প্রথম সাজা ঘোষণার পরও রয়ে গিয়েছে একাধিক প্রশ্ন। একা সঞ্জয় রায়ই দোষী? ঘটনার দিন আর জি করের সেমিনার হলে যা যা হয়েছিল, এবং পরবর্তী সময় ওই ঘটনায় সিবিআই আর জি করের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং স্থানীয় টালা থানার ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকেও গ্রেফতার করেছিল সিবিআই। তাঁদের বিরুদ্ধে কেন এখনও প্রমাণ জমা করতে পারল না তদন্তকারীরা, সেই প্রশ্নও উঠছে। বারবার কেন বলা হচ্ছে একা সঞ্জয় রায়ই ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত, যেখানে একাধিক প্রমান বলছে ওই নারকীয় ঘটনা একার পক্ষে সম্ভব নয়। ওই তরুণী চিকিৎসকের পরিবার যে বারবার ক্রাইম সিনে প্রমাণ লোপাটের দাবি জানিয়ে আসছিল, এমনকি জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই ৩৫টি প্রশ্ন তুলে ৫৭ পাতার একটি রিপোর্ট শিয়ালদা আদালতের বিচারকের কাছে জমা দিয়েছিল, তার কি হল সেই প্রশ্নও উঠছে।
প্রথমেই যে অভিযোগটি সবচেয়ে বড় আকারে সামনে আসছে, সেটা হল কেন্দ্র ও রাজ্যের সেটিং। আর জি করের ঘটনায় সেটাই সত্যি বলে মনে হচ্ছে বলে মেনে নিচ্ছেন জুনিয়র চিকিৎসকরা এবং সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশ। যারা আর জি করের ঘটনার পর দিন-রাত এক করে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন। বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসকমহলের একাংশের দাবি, আর জি কর হাসপাতালে ওই তরুণী চিকিৎসকের উপর যে নির্মম অত্যাচার করা হয়েছিল, তা কার্যত প্রমাণিত। নির্যাতিতার পোস্ট মর্টেম তড়িঘড়ি করানো এবং দ্রুততার সঙ্গে দেহ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় একটা গভীর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দেয়। আর এই ষড়যন্ত্রে যে রাজ্যের উপরমহলের অনেকে যুক্ত সেটাও বোঝা যায়। নির্যাতিতার পরিবার, তথা বাবা-মা বারবার দাবি করেছিলেন, তাঁদের প্রথমে ফোন করে আত্মহত্যার কথা বলা হয়েছিল। পরে তাঁরা হাসপাতালে পৌঁছলেও মেয়ের মৃতদেহ দেখতে দেওয়া হয়নি। প্রায় তিন ঘণ্টার বেশি সময় বসিয়ে রাখা কেন হয়েছিল? নির্যাতিতার পোস্ট মর্টেমে যে বিপুল পরিমাণ আঘাতের উল্লেখ আছে, তা কোনও ভাবে একার পক্ষে অল্প সময়ে করা সম্ভব নয় বলেই দাবি চিকিৎসকদের। এও জানা যাচ্ছে, সেন্ট্রাল ফরেনসিক ল্যাবের রিপোর্টে নির্যাতিতার যৌনাঙ্গ ও পায়ুর স্যাম্পলে অন্তত অন্য একজনের ডিএনএ পাওয়া গেছে। কে সে? তার উত্তরও অজানা রইল। তদন্তকারীরা কি বাকিদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করেননি? নাকি এর পিছনে অন্য কোনও অঙ্ক রয়েছে। সিবিআই সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকে গ্রেফতার করার পর দাবি করেছিল, এই ঘটনায় আরও উপরমহলের হাত রয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, সন্দীপ ঘোষ ও অভিজিৎ মণ্ডলকে আর জি কর হাসপাতালে ধর্ষণ ও খুনের তথ্যপ্রমান লোপাটের অভিযোগে গ্রেফতার করা হলেও মূল চার্জশিটে তাঁদের নাম রাখা হয়নি। কেন? সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট কবে জমা দেবে সিবিআই, নাকি এবারও বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদবে?
Discussion about this post