বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুসের আর্জি মেনে বৈঠকে বসলেন বটে, তবে মোদীর মুখে নেই চওড়া হাসি। এমনকি শিষ্টাচার মেনে করলেন না আলিঙ্গনও। নরেন্দ্র মোদি যখন কোনও বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তখন প্রথম দর্শনেই বুকে জড়িয়ে নেন বিদেশী অভ্যাগতকে। থাইল্যান্ডের ব্যাঙ্কক শহরে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বসলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি সাধারণত বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে আলিঙ্গন করে থাকেন। তাৎপর্যপূর্ণভাবে এবার মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে তিনি আলিঙ্গন করেননি। শুধু নমস্কার এবং করমর্দন করেছেন।
আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরসূচির মধ্যে ইউনুসের সঙ্গে বৈঠকের কোনও উল্লেখই করা হয়নি। এমনকী প্রধানমন্ত্রী মোদি বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর শুক্রবারের কর্মসূচির কথা জানিয়ে এক্স হ্যন্ডলে যে পোস্ট করেছেন তাতেও বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি উল্লেখও করেননি। তবুও বৈঠকে বসলেন তিনি এবং তা বাংলাদেশের বারংবার করা আর্জি মেনেই। এমনটাই জানা যাচ্ছে বিভিন্ন সূত্র থেকে। তবে ব্যাঙ্ককে মোদি-ইউনূসের এই বৈঠক ঘিরে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ব্যপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশের প্রেস সচিব আগ বাড়িয়ে জানিয়ে দিলেন, কি কি বিষয় নিয়ে দু-দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের আলোচনা হয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের অস্থিরতা ও সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার নিয়ে বেশ কয়েক বার সুর চড়িয়েছে ভারত। এমনকি, সংখ্যালঘু নিরাপত্তার খাতিরে ঢাকায় বিদেশসচিব বিক্রম মিশ্রিকেও পাঠানো হয়েছিল নয়াদিল্লির তরফে। কিন্তু বাংলাদেশ ভারতের এই অভিযোগ বারবার অস্বীকার করে এসেছে। ফলে দুই দেশের সম্পর্ক ক্রমশ অবনতির দিকে গিয়েছে। অন্যদিকে, সাম্প্রতিক কালে মুহাম্মদ ইউনূস চিন সফরে যান, এবং সেখানে ভারতের সেভেন সিস্টার্স নিয়ে এক বিতর্কিত মন্তব্য করেন। যা নিয়ে ভারতের বিভিন্ন মহলে ক্ষোভ চরম আকার ধারণ করে। অনেকেই দাবি তোলেন, এবার বাংলাদেশকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়া উচিৎ। কিন্তু এই আবহেও ‘নৈরাজ্যপূর্ণ’ বাংলাদেশকে দূরে ঠেলে দেয়নি ভারত। বরং আর্জি মেনে বৈঠকে বসলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তবে ঠিক কি কি বিষয়ে আলোচনা হল দুই দেশের রাষ্ট্র নেতার? ভারতের তরফে কিছু জানানো না হলেও বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, ‘ভারতের সঙ্গে আমাদের পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট যতগুলো ইস্যু আছে, তার সব কটি বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা আমাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সব কটি বিষয় আলোচনায় তুলেছেন। আলোচনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ, ভারতে বসে তিনি যেসব উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন সে প্রসঙ্গ, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, গঙ্গার পানি চুক্তির নবায়ন, তিস্তা চুক্তির প্রসঙ্গ এসেছে। দুই শীর্ষ নেতার আলোচনা ইতিবাচক ও ফলপ্রসূ হয়েছে’।
বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব যাই দাবি করুক না কেন, এটা প্রকৃত তথ্য নাও হতে পারে বলেই মনে করছেন ভারতীয় কূটনৈতিক মহল। কারণ, বৃহস্পতিবার থ্যাইল্যান্ড সরকারের দেওয়া নৈশভোজে নরেন্দ্র মোদি এবং মুহাম্মদ ইউনূস পাশাপাশি বসেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল, দুজনের মুখ গম্ভীর, হাসি নেই। এমনকি কেউ কারও দিকে চোখা-চুখি করলেন না। কিন্তু রাত পোহাতেই তাঁরা বসলেন বৈঠকে। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট করা হয়েছে এই বহু প্রতিক্ষিত বৈঠক নিয়ে। ইউনূস এদিন নরেন্দ্র মোদিকে একটি ছবি উপহার দিয়েছেন, যেখানে ২০১৫ সালে ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মোদি মুহাম্মদ ইউনূসকে স্বর্ণপদক পরিয়ে দিচ্ছেন। কূটনৈতিক মহলের মতে, ইউনূস বোঝাতে চাইলেন তাঁর সক্ষমতা। কিন্তু মোদি কি আদৌ সেরকম ভাবছেন? শুক্রবার এক সাংবাদিক সম্মেলন করেন ভারতের বিদেশসচিব বিক্রম মিশ্রি। তিনি ব্যাঙ্ককে প্রধানমন্ত্রীর সফর ঘিরে নানা প্রশ্নের উত্তর দেন। মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির বৈঠক প্রসঙ্গে তিনি যা বলেন সেটার অর্থ করলে দাঁড়ায় প্রধানমন্ত্রী মোদি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপুর্ণ, প্রগতিশীল এবং অন্তর্ভূক্তিমূলক বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশের সঙ্গে একটা ইতিবাতক এবং গঠনমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে ভারতের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি এই পরিবেশ বিপর্যস্ত করে এমন যে কোনও মন্তব্য করার থেকে বিরত থাকার আহ্বানও জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে হিন্দু-সহ অন্যন্য সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের উদ্বেগ সরাসরি জানান মুহাম্মদ ইউনূসকে। সেই সঙ্গে তিনি স্বীকার করেন, শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু এ বিষয়ে আর কিছু বলা যাবে না।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থাইল্যান্ডের ব্যাঙ্ককে বিমসটেক সম্মেলনের নানান মুহূর্তের ছবি ও ভিডিও তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া পেজে প্রকাশ করছেন। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের কোনও ছবি বা তথ্য তিনি শেয়ার করেননি। যেথানে ভূটানের রাষ্ট্রপ্রধান বা মিয়ানমারের বিতর্কিত সেনাশাসকের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের ছবি শেয়ার করেছেন। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, কাছাকাছি, তবুও যেন অনেক দূরে নরেন্দ্র মোদি ও মুহাম্মদ ইউনূস।
Discussion about this post