স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভারতের প্রথম সর্ববৃহৎ প্রকল্প বলা যায় ফারাক্কা বাঁধ নির্মানকে। যা পশ্চিমবঙ্গের মুর্শইদাবাদ জেলায় ফারাক্কা শহরে অবস্থিত। যা পড়শি দেশ বাংলাদেশ থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ভারতের দীর্ঘতম নদী গঙ্গা অববাহিকায় সেচের জলের উন্নত পরিকাঠামো তৈরি এবং কলকাতা বন্দরকে পলিমুক্ত করে জলের জোগান বাড়ানোর উদ্দেশ্যে গঙ্গায় একটি বাঁধ নির্মানের পরিকল্পনা সেই ব্রিটিশ আমলেই হয়েছিল। ১৮৫১ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে মোট পাঁচটি সমীক্ষাও করে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। এরপর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু গঙ্গায় একটি বাঁধ নির্মানের প্রকল্প হাতে নেন। মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কাতেই এই বাঁধ নির্মানের রূপরেখা তৈরি হয়। আর এই বিশাল বাঁধ নির্মানের বরাত দেওয়া হয় সেই সময়ের রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা হিন্দুস্থান কনস্ট্রাকশন কোম্পানিকে। ফারাক্কা বাঁধের নির্মানকাজ শুরু হয় ১৯৬৫ সালে। পুরো কাজ শেষ হতে সময় লেগে যায় ১০ বছর। ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল ফারাক্কা বাঁধ জনগণের উদ্দেশ্যে খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় বাংলাদেশের সঙ্গে জলবন্টন নিয়ে।
গঙ্গানদীর মূল ধারা ফারাক্কা থেকে সোজা বাংলাদেশে ঢুকে পদ্মা নামে বঙ্গোপসাগরের দিকে বয়ে গিয়েছে। অপর ধারাটি হুগলি নদী নামে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে কলকাতা বন্দরের দিকে প্রবাহিত হয়েছে। ফলে জলের অভাবে কলকাতা বন্দরে নাব্যতা কমতে থাকে এবং পলি জমতে শুরু করে। বিশেষ করে গরমের মরশুমে হুগলি নদীর নাব্যতা অনেক কমে যায়। এই সময় কলকাতা বন্দরে চুরান্ত সমস্যার সৃষ্টি হতো। ফারাক্কা বাঁধ নির্মানের পর প্রতি বছর গরমের সময় ৪০ হাজার কিউসেক জল হুগলি নদীতে চালনা করা হয়। এতে নদীর নাব্যতা বজায় থাকে। জলের অভাবে বসে যেতে থাকা হুগলি ও ভাগীরথী ফের গঙ্গার জলে পুষ্ট হতে শুরু করে। পাশাপাশি ফারাক্কা বাঁধের বিভিন্ন ফিডার ক্যানেলগুলি দিয়ে পানীয় জল এবং সেচের জল সরবরাহ করা হচ্ছে। ফারাক্কায় ছোট-বড় মিলিয়ে ৬০টি ফিডার ক্যানেল রয়েছে। এছাড়া রয়েছে এনটিপিসির তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে জল সরবরাহ করা। তবে ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মানের মূল উদ্দেশ্যই হল, ড্রেজিং ছাড়া কলকাতা বন্দরে পলি জমা আটকাতে প্রতি সেকেন্ডে ১,৮০০ ঘণ মিটার জল হুগলি নদীকে সরবরাহ করা।
কিন্তু ফারাক্কা বাঁধ নির্মানে অনেকগুলি সুবিধা হওয়ার পরও কিছু সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে পরবর্তী সময়ে। ফারাক্কা বাঁধের উপর একটি সড়ক এবং একটি রেল সেতুও তৈরি হয়েছে। এই দুটি ফলে সাবেক ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে দক্ষিণের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের সরাসরি রেল এবং সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করা গিয়েছে। কিন্তু অপরদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে জলবন্টন নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ফারাক্কা বাঁধ নির্মানের বিরোধীতা করে। কিন্তু ভারত সেই বিরোধীতা কানে না তুলেই বাঁধ নির্মান চালিয়ে যায়। পরবর্তী সময় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি ফারাক্কা পয়েন্টে জলবন্টন নিয়ে বৈঠক করেন। এই বৈঠক শেষে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী যৌথ বিবৃতিও দিয়েছিলেন। তাতে ঠিক হয়, দুই দেশের মধ্যে জলবন্টনের পাকাপাকি চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত ফারাক্কা বাঁধ চালু করা হবে না। কিন্তু ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবর হত্যার পরই ভারত একতরফাভাবে ফারাক্কা বাঁধ চালু করে দেয়। ১৯৭৬ সালে গরমের সময় গঙ্গা নদী থেকে ভারত ১১৩০ কিউসেক জল হুগলি এবং ভাগিরথী নদীতে ছাড়তে শুরু করে। এরই বিরোধীতা করে ১০৭৭ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রসংঘে নালিশ জানায়।
এর ২০ বছর পর অবশেষে ভারত এবং বাংলাদেশ ফারাক্কার জলবন্টন নিয়ে ঐক্যমতে পৌঁছতে পারে। ১৯৯৬ সালে দুই দেশের মধ্যে ফারাক্কার জলবন্টন নিয়ে ৩০ বছরের চুক্তি সাক্ষর হয়েছিল। যদিও এতে বাংলাদেশ বা ভারতকে নিঃশর্ত ন্যূনতম পরিমাণ জল সরবরাহ করার জন্য কোনও গ্যারান্টি ক্লজ ছিল না। ফলে আজও বাংলাদেশের একাংশ একে ব্যার্থ চুক্তি বলেই আখ্যা দিচ্ছেন। ফলে ফারাক্কা বাঁধ আজও দুই দেশের সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতের ভিতরেও রয়েছে অসন্তোষ। ফি বছর বিহারের বন্যার জন্য বিশেষজ্ঞদের একাংশ ফারাক্কা বাঁধকেই দায়ি করেন। উল্লেখ্য, গত কয়েক বছরে জুলাই-আগস্ট মাসে সুখা মরশুমেও বিহারে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়। এর জন্য ফারাক্কা বাঁধ অনেকাংশেই দায়ি বলে মনে করেন। কারণ হিসেবে বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কা বাঁধ গঙ্গার মূল প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফারাক্কা বাঁধ নির্মানের ফলে উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলা থেকে বিহারের ভাগলপুর জেলার মধ্যে প্রচুর পলি জমা হয়ে যায়। এর ফলে গঙ্গা নদীর তলদেশের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই বিহারে রেকর্ড পরিমাণ বন্যা দেখা যাচ্ছে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি মুর্শিদাবাদ, মালদহ জেলার বিভিন্ন অংশে গঙ্গা তীরের ভাঙনও এই বাঁধের জেরেই হচ্ছে বলে মনে করেন অনেকে।
Discussion about this post