কলকাতার বুকে হলেও যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের কয়েকটি বিধানসভা শহরতলি এবং গ্রামকেন্দ্রীক। ফলে যাদবপুরে বরাবরই মিশ্র ফলাফল লক্ষ্য করা যায়। যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা হল যাদবপুর, টালিগঞ্জ, সোনারপুর উত্তর, সোনারপুর দক্ষিণ, বারুইপুর পূর্ব, বারুইপুর দক্ষিণ এবং ভাঙর। ফলে একদিকে যেমন দক্ষিণ কলকাতার সম্ভ্রাম্ত ভোটার অন্যদিকে শহরতলির গ্রামগুলির সাধারণ ভোটার রয়েছেন। ফলে এই লোকসভার ফলাফল নির্ভর করে শহরতলির ভোটারদের মানসিকতার ওপর। ফলে একসময় যাদবপুর যেমন ছিল লালদূর্গ, তেমনই পরবর্তনের আগে থেকেই যাদবপুরের হাওয়া ঘুরতে শুরু করে। কিন্তু ২০০৯ লোকসভা ভোট থেকেই দেখা যাচ্ছে, যাদবপুরে তৃণমূল কংগ্রেস বারবার প্রার্থী বদল করছে। তাৎপর্যপূর্ণ দিক হল, এবারের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে এসে স্বয়ং তৃণমূল নেত্রীও স্বীকার করে নিয়েছেন, বিদায়ী সাংসদ তথা অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তী এখানে ঠিকভাবে কাজই করতে পারেননি। এরজন্য তিনি যাদবপুরের ভোটারদের কাছে ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছেন।
২০০৯,২০১৪ এবং ২০১৯-এর বিগত তিনটি লোকসভা ভোটে যাদবপুরে ফুটেছে ঘাসফুল। কিন্তু তবুও প্রতিবার বিজয়ী প্রার্থীদের টিকিট দেননি তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে অনেক আশা নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী করেছিল প্রখ্যাত গায়ক কবীর সুমনকে। তিনি জিতেছিলেন ৫৬ হাজার ২৬৭ ভোটে। পরাস্ত করেছিলেন বিদায়ী সাংসদ সিপিএমের সুজন চক্রবর্তীকে। কিন্তু পরবর্তী পাঁচ বছরে কবীর সুমনে মোহভঙ্গ হয় তৃণমূলের। এরপর ২০১৪ লোকসভা ভোটে কবীর সুমনকে সরিয়ে তৃণমূল টিকিট দেয় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সুগত বসুকে। কিন্তু ২০১৯ সালে তাঁকেও বাদ দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। সেবার টলিউডের নায়িকা মিমি চক্রবর্তীকে টিকিট দিয়েছিলেন যাদবপুর কেন্দ্রে। ২০১৯-এ মিমি রেকর্ড ভোটে জেতেন, জয়ের ব্যবধান ২ লক্ষ ৯৬ হাজার ২৩৯ ভোট। কিন্তু এবারও মিমি্ চক্রবর্তীর ওপর মোহভঙ্গ হয় তৃণমূল নেত্রীর। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে মিমির বদলে টিকিট দিলেন আরেক টলি নায়িকা সায়নী ঘোষকে। যদিও সায়নী দীর্ঘদিন ধরেই তৃণমূলের নেত্রী হিসেবে কাজ করছেন।
২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি মন্তব্য ঘিরে শোরগোল পড়ে যায়। তিনি বর্তমান তৃণমূল প্রার্থী সায়নী ঘোষের সমর্থনে এক জনসভায় প্রকাশ্যে বলেন, “আমার প্রার্থী সায়নী। আগের বার আপনারা অতটা সার্ভিস পাননি। সায়নী এলাকায় পড়ে থেকে লড়াই করবে এবং দাঁতে দাঁত দিয়ে উন্নয়নের কাজ করে যাবে”। অর্থাৎ তৃণমূল সুপ্রিমো নিজেই স্বীকার করলেন, গতবারের সাংসদ মিমি কাজ করেননি। কিন্তু হিসাব বলছে সাংসদ তহবিলের টাকা সব থেকে বেশি খরচা করেছিলেন মিমি চক্রবর্তীই। এখানেই প্রশ্ন উঠছে মিমি তাহলে কি অপরাধ করলেন। উল্লেখ্য, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মমতার দফতরে ইস্তফাপত্র পাঠিয়েছিলেন মিমি। কিন্তু লোকসভার নিয়ম অনুযায়ী পাঁচ বছর কাটানোর পরে বিদায়ী সাংসদের কোন ইস্তফা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ফলে তিনি যে এবার ভোটে দাঁড়াতে চাইছেন না সেটা পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল। ফলে এবার প্রার্থী হলেন আরেক টলি তারকা সায়নী ঘোষ।
বিরোধীদের প্রশ্ন, সাংসদ হিসেবে মিমি যে কাজ করেননি সেটা পাঁচ বছর হয়ে যাওয়ার পর কেন মনে পড়ল? বিগত পাঁচ বছরে কেন তিনি মিমিকে ডেকে সাবধান করেননি? পাশাপাশি এই প্রশ্নও উঠছে, যদি তিনি কাজই না করে থাকেন, তাহলে মিমি চক্রবর্তীর সাংসদ তহবিলের টাকা কারা খরচ করেছিল? আসল কথা হল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র নিয়ে বরাবরই চিন্তায় থাকেন। তাই কোনও সাংসদের কাজেই তিনি সন্তুষ্ট হন না। যাদবপুর এমনই এক লোকসভা কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে বিদায়ী সাংসদরা একবারের বেশি টিকিট পাননি। ২০০৯-এর কবীর সুমনের পর ২০১৪ সালে সুগত বসু। ২০১৯ সালে তৃণমূল ফের প্রার্থী বদল করে যাদবপুরে, টিকিট পান মিমি চক্রবর্তী। কিন্তু ট্রাডিশন বজায় রেখে ২০২৪ সালের লোকসভাতেও বদলে গেলেন প্রার্থী। বিরোধীদের প্রশ্ন, এবার জিতলেই কী যাদবপুরের জন্য কাজ করবেন সায়নী? নাকি তিনিও পূর্বসূরীদের পথে হাঁটবেন। আগামী ৪ জুন সেই প্রশ্নের আগাম আন্দাজ পাওয়া যাবে।
Discussion about this post