শিয়রে বিপদ! সাম্প্রতিক অতীতে হিমালয়ের কোলে ভারতের উত্তর-পূর্বের ছোট্ট রাজ্য সিকিমে বারবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের খবর আসছে। কখনও হিমবাহ হ্রদ ফেটে হড়পা বান, কখনও প্রবল বৃষ্টিতে ধস, আবার কখনও তিস্তার জলস্তর বেড়ে জাতীয় সড়ক গ্রাস করে নেওয়া। বলা যায়, প্রকৃতির ভয়ানক রোষে পড়েছে সিকিম। কিন্তু কেন বারবার সিকিমেই বিপর্যয় ঘনিয়ে আসছে? অনেক কারণের মধ্যে উঠে আসছে মানব সভ্যতার বাড়াবাড়ি।
গত বছরের অক্টোবর মাসে সিকিমের লোনাক হ্রদের হিমবাহ ফেটে মহাবিপর্যয় নেমে এসেছিল সিকিমের বুকে। সেই সময় উত্তর সিকিমের একটা বিস্তৃর্ণ অংশে ভয়াল বন্যার স্মৃতি আজও টাটকা সিকিমবাসী এবং সেখানে আটকে থাকা পর্যটকদের কাছে। সেই স্মৃতি ফিঁকে হওয়ার আগেই ফের সিকিমে বিপর্যয় নেমে এসেছে। এবার জুন মাসের তীব্র গরমেই সিকিমে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। বিশেষজ্ঞরাও তাজ্জব, অক্টোবরের প্রবল শীত হোক বা জুন মাসের গরম, সিকিমে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আবহ একই থাকল। এবার বিপর্যয়ের তীব্রতা আর ব্যাপ্তি আরও বেশি। গোটা সিকিমই কার্যত ধসের কবলে ভারতের বাকি অংশের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। জায়গায় জায়গায় ভূমি ধসের কারণে ভেঙে নদীর সঙ্গে মিশে গিয়েছে দশ নম্বর জাতীয় সড়ক। তিস্তার জল বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। এখনও পর্যন্ত ছয় থেকে সাত জনের মৃত্যুর খবর সামনে এসেছে। এমনকি তিস্তার জল এখন সিকিম ছাপিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পং জেলায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ফলে হাঁসফাঁস করা গরমের থেকে মুক্তি পেতে পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদের অবস্থা এখন করুণ। কারণ দীর্ঘদিন ধরে হাজার হাজার পর্যটক সিকিমে আটকে রয়েছেন।
বিগত কয়েক বছর ধরেই সিকিমে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরিমান বেড়ে চলেছে। গত বছরের শেষদিক থেকে আজ পর্যন্ত সিকিমের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। কিন্তু কেন বারবার সিকিমেই ঘনিয়ে আসছে বিপর্যয়ের কালো মেঘ? বিশেষজ্ঞরা এর পিছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে দাবি করছেন। যার মধ্যে অন্যতম গ্লোবাল ওয়ার্মিং। এই কারণেই গত বছর হিমবাহ হ্রদ ফেটে ভয়াল বন্যা হয়েছিল বলে দাবি করছেন। বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন, গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জেরে হিমালয়ের এই অঞ্চলে বিগত কয়েক বছরে ছোট ছোট হ্রদের সংখ্যা বেড়েছে। যা ক্রমাগত হিমবাহ গলা জলে পুষ্ট হচ্ছে। গলনের জেরে হিমবাহগুলি ক্রমাগত পিছনের দিকে সরে যাচ্ছে। আর এর ফলে সেই জায়গায় তৈরি হচ্ছে শূন্যতা। ফলে মাটির চাপ আলগা হয়ে যাচ্ছে। এর ফলস্বরুপ হিমবাহ ফেটে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। যেমন হয়েছিল গত বছর। ২০২৩ সালের ৩ অক্টোবর উত্তর সিকিমের লোনাক হ্রদের ওপর হিমবাহ ফেটে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়েছিল। আবার হিমালয়ের উত্তরপ্রান্তে অর্থাৎ ট্রান্স হিমালয়ান অঞ্চলে মেঘভাঙা বৃষ্টিও বিজ্ঞানীদের আতসকাঁচের নীচে রয়েছে। কারণ ওই অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমান খুবই কম হওয়ার কথা। সেখানেও গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে বারবার মেঘভাঙা বৃষ্টি হচ্ছে। তবে বিজ্ঞানীদের একাংশ আবার ভূমিকম্পপ্রবণ নেপালকেও দায়ি করছেন সিকিমের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য। নেপালে বারবার ভূমিকম্পের জেরে হিমবাহগুলি নিজের স্থান পরিবর্তন করে নীচের দিকে নেমে আসছে, আর হ্রদের জায়গা দখল করছে। ফলে হ্রদ ফেটে বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
সম্প্রতি ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর ন্যাশনাল রিমোর্ট সেন্সিং সেন্টার সিকিমের একাধিক ছবি তুলেছে কৃত্তিম উপগ্রহগুলি থেকে। সিকিমের ঘনঘন বিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে ওই উপগ্রহ চিত্রগুলি খুবই কাজে এসেছে ছবিগুলি বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা সহমত পোষণ করছেন যে, সিকিমের লোনাক হ্রদের আকার এবং চরিত্র ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছিল। সেখানকার ভূমির চরিত্র বদলের জন্যই সম্ভবত হিমবাহ ফেটে বড় চাঁই নেমে আসে লোনাক হ্রদের উপর। যার ফলেই গত বছর সিকিমে ভয়াবহ বিপর্যয়।
এ তো গেল প্রাকৃতিক তত্ত্ব। কিন্তু বিজ্ঞানীমহলের একাংশ সিকিমের বিপর্যয়ের জন্য সরকারের নানা অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তকেই দায়ি করছেন। নবীন হিমালয়ের ওপর দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকা সভ্যতা এর জন্য দায়ি। উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ বা সিকিম বরাবরই ধসপ্রবণ। তবুও এই অঞ্চলে দ্রুতগতিতে বাড়িঘর, হোটেল, রিসর্ট গড়ে উঠছে। রাস্তা চওড়া করার জন্য পাহাড়ের ঢাল কাটা হচ্ছে। নির্বিচারে কাটা হচ্ছে গাছও। আবার পাহাড় চিরে বড় বড় টানেল তৈরি হচ্ছে। আর সর্বপরি নদীগুলির স্বাভাবিক জলপ্রবাহ আটকে বাঁধ তৈরি হচ্ছে। প্রকৃতির ওপর মানবসভ্যতার এই খবরদারি একেবারেই মেনে নিতে পারছে না প্রকৃতি। ফলে সামান্য বর্ষাতেই পাহাড়ে ভূমিধস হচ্ছে। আর বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে হিমালয়ের কোলে ছোট্ট রাজ্য সিকিম।
Discussion about this post