সৃষ্টির আদি রহস্য লুকিয়ে রয়েছে এখানেই। স্বয়ং মহাদেব শিব এখানে স্থাপন করেছেন ত্রিভুবন। তাই সেই আদি কাল থেকেই এই পাতাল গুহা নিয়ে মানুষের কৌতূহলের অন্ত নেই। তবে চাইলেই এই গুহায় আপনি ঢুকতে পারবেন না। কারণ এতটাই সংকীর্ণ এর প্রবেশপথ। একবার একজন মাত্র অতি কষ্টে লোহার শিকল ধরে কোনও মতে মাটির ৯০ মিটার গভীরে নেমে যেতে পারবেন। সিঁড়ির বালাই নেই, কিছুটা খাঁজ কাটা পাথরের সুরঙ্গ বেয়ে মাথা বাঁচিয়ে নামতে হবে অতি সাবধানে। কিন্তু নীচে পৌঁছতে পারলে আপনি নিজেকে খুঁজে পাবেন অন্য জগতে। কথিত আছে, এই পাতাল গুহায় রয়েছে গণেশের সেই কাটা মাথা। এখানেই ৩৩ কোটী দেবতার বাস। এখানেই একসাথে দেখা যায় চার ধাম। অপার রহস্যময় এই গুহার নাম পাতাল ভুবনেশ্বর।
উত্তরাখণ্ডকে যে কেন দেবভূমি বলা হয়, তার প্রমান আপনি পাহাড়ের প্রতিটি বাঁকেই পেয়ে যাবেন। কিন্তু পাতাল ভুবনেশ্বরে একবার প্রবেশের পর এই ‘দেবভূমি’ একেবারে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাবে। অতি প্রাচীন এই গুহায় প্রতিটি কোনায় কোনায় রয়েছে রহস্যের মোড়ক। মাটির নিচেই দেবতাদের বাস, তাই এর নাম পাতাল ভুবনেশ্বর। উত্তরাখণ্ডের পিথরাগড় জেলায় ঘন পাইন ঘেরা জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত ছোট্ট জনপদ গঙ্গোলিহাট। এর কাছেই মাটির নিচে অবস্থান করছে পাতাল ভুবনেশ্বর।
পাতাল শব্দটার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এক অজানা অচেনা রহস্যময় জগৎ। আর পাতালের কোনও গুহায় যদি পৌরাণিক কাহিনী সন্ধান পাওয়া যায়, তাহলে মানুষের কৌতুহল বাড়তেই থাকবে। যেমন উত্তরাখণ্ডের পিখরাগড় জেলার পাতাল ভুবনেশ্বর গুহা মন্দির। কথিত আছে হিন্দুদের তেত্রিশ কোটী দেবতাদের বাস এখানে। আবার এখানেই আপনি দেখতে পাবেন গণেশের কাটা মাথা।
বিশ্বাস পাতাল ভুবনেশ্বর গুহার বয়স নাকি পৃথিবীর বয়সের সমান। স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব এই এই গুহা তৈরি করেছিলেন। গণেশের জন্ম বৃত্তান্ত সম্পর্কে আমরা সকলেই জানি, মাতা পার্বতী গণেশ কি সৃষ্টি করার পর মহাদেব তাঁর ত্রিশূল দিয়ে গণেশের মুন্ডচ্ছেদ করেন। এরপর মাথা পার্বতীর বিলাপ দেখে হাতির কাটা মুন্ডু জোরে গণেশের প্রাণসঞ্চার করেন। কিন্তু কৌতুহল জাগে না গণেশের আসল কাটা মাথাটি কোথায়? বিশ্বাস সেই কাটা মাথাটি পাতাল ভুবনেশ্বরেই স্থাপন করেছেন মহাদেব। গঙ্গোলিহাট থেকে ১৮ কিমি দূরে শান্ত নির্জন গভীর অরণ্যের মধ্যে এই গুহা। মূল প্রবেশপথ থেকে ৯০ মিটার মাটির গভীরে এই চুনা পাথরের গুহা। ১৬০ মিটার বিস্তৃত এই গুহা যুগ যুগ ধরে বহু রহস্য বুকে আগলে নিয়ে রয়েছে। এখানে পৌঁছাতে পারলে আপনি নিজেকে পাবেন এক অন্য জগতে। স্কন্ধ পুরাণের মানসখন্ডে এই গুহার প্রথম বর্ণনা পাওয়া যায়।
পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, সূর্যবংশীয় রাজার ঋতুপর্ণ হরিণ শিকার করতে গিয়ে প্রথম এই গুহার দর্শন পান সেই ত্রেতা যুগে। জানা যায় রাজা ঋতুপর্ণ শ্রী রামের পরবর্তী সময়ে অযোধ্যা শাসন করেছিলেন। পরবর্তীকালে কলি যুগে, আনুমানিক ৭২২ খ্রিস্টাব্দে আদি শঙ্করাচার্য এই গুহা খুঁজে বের করেন। এবং মূল শিবলিঙ্গটি তামা দিয়ে ঘিরে দেন। কারণ এখানে অবস্থিত শিবলিঙ্গটির তেজ এতটাই জোরালো যে, যেকোনও মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে পারতেন। কথিত আছে ভগবান শিব এখানেই পাতালবাস করেন, তাই তাঁর পুজো করতে সমস্ত দেব-দেবী এখানেই অবস্থান করেন।
শিব পুরাণের কাহিনী অনুযায়ী, গণেশের কাটা মুন্ডটি এই পাতাল ভুবনেশ্বরই স্থাপন করেছেন দেবাদিদেব মহাদেব। তিনি স্বয়ং এখানে পাহারায় থাকেন। ১৬০ মিটার বিস্তৃত এই পাতাল গুহার অনেকগুলো গুহামুখ রয়েছে। সমস্ত গুয়ামুখ যেখানে এসে মিলিত হয়েছে সেই বিস্তৃত হলঘরে যে উঁচু ঢিবির মতো পাথরটি রয়েছে, লোকবিশ্বাস সেটি গনেশের কাটা মাথা। গুহার মধ্যে গণেশের শিলারূপী মুন্ডের ওপর ১০৮টি পাপড়িযুক্ত শবাষ্টকদল ব্রহ্মকমল বিদ্যমান। এই ব্রহ্মকমল থেকে গণেশের মাথায় দিব্য জল বিন্দু পড়ে। বিশ্বাস, স্বয়ং মহাদেব এই ব্রহ্মকমল স্থাপন করেছেন। এই গুহা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য যেন।কথিত আছে, এই গুহা স্বয়ং কালভৈরবের মুখ। তাই কালভৈরবের মুখ দিয়ে প্রবেশ করে লেজ পর্যন্ত যেতে পারলে মোক্ষ লাভ হয়। এই গুহাতেই বদ্রীনাথ, কেদারনাথ ও অমরনাথের দর্শন করা যায়। বদ্রীনাথে বদ্রী পঞ্চায়েতের শিলারূপী মূর্তি এখানে রয়েছে। এই পঞ্চায়েত হলেন যম, কুবের, বরুণ, লক্ষ্মী, গরুড় ও গণেশ। এই পঞ্চায়েতের ওপরে অমরনাথ গুহা রয়েছে। আসলে পাতাল ভুবনেশ্বর গুহা চুনাপাথরের তৈরি। গুহার দেওয়াল জুড়ে অপূর্ব সব ভাস্কর্য তৈরি হয়েছে। এবং আশ্চর্যজনকভাবে প্রতিটি বিভিন্ন দেবদেবীর নানান রূপের মূর্তি। যা প্রাকৃতিক উপায়েই তৈরি হয়েছে। পুরাণ অনুযায়ী একমাত্র পাতাল ভুবনেশ্বর গুহাতেই একসাথে অমরনাথ কেদারনাথ ও বদ্রিনাথের দর্শন পাওয়া যায়। গণেশের কাটা মাথাও এখানে রয়েছে। সবমিলিয়ে পাতাল ভুবনেশ্বর আপনার জন্য দাঁড়িয়ে আছে পুরাণ ও রহস্যের বন্ধ দরজা নিয়ে।
আবার এখানেই নাকি কলি যুগের ইঙ্গিত রয়েছে। পাতাল ভুবনেশ্বর গুহায় চারটি বড় বড় পাথর রয়েছে, যার মধ্যে একটি কলিযুগের প্রতীক। এই পাথরটি ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। বিশ্বাস প্রতি হাজার বছরে সামান্য বড় হয় এই পাথরটি। এটি যেদিন গুহার দেওয়াল স্পর্শ করবে, সেদিনই কলিযুগের অবসান ঘটবে বলেই ভক্তদের বিশ্বাস।
Discussion about this post