বর্ষা আসলেই সেজে ওঠে প্রকৃতি। আর সেটা যদি পাহাড়ি উপত্যকা হয়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। ভারতের গোটা উত্তর প্রান্ত জুড়ে রয়েছে হিমালয় পর্বতমালা। আর সুবিশাল হিমালয়ের প্রতিটি বাঁকেই রয়েছে অজানা রহস্য। একদিকে যেমন প্রকৃতিক নৈস্বর্গ, অন্যদিকে ধর্মীয় মাহাত্ম। পাশাপাশি এডভেঞ্চার প্ৰিয় মানুষদের কাছে হিমালয় যেন স্বর্গরাজ্য। সবমিলিয়ে হিমালয় যুগ যুগ ধরে মানুষকে আকৃষ্ট করে আসছে তাঁর অপ্রাকৃত মহিমায়।
আমরা আজ কথা বলবো, ফুলের উপত্যকা নিয়ে। আসলে গোদা বাংলায় এটা বললাম, তাই হয়তো বুঝতে পারলেন না। ভ্রমনপ্রিয়, প্রকৃতিপ্রেমী বা এডভেঞ্চার করতে ভালোবাসেন এমন মানুষদের কাছে ফুলের উপত্যকা পরিচিত “ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স” বা “ফুলো কি ঘাঁটি” নামে। যা অবস্থিত উত্তরাখন্ডের চমোলি জেলায়। এটি ইউনেস্কোর ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ এবং সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত।
একপাশে পাহাড়ি পুষ্পবতী নদী, অন্যপাশে আদিম অরণ্য। সেখানে নাম না জানা অসংখ্য গাছ, পাখির কলকাকলি আর সুন্দর সুন্দর ফুলে ভরা পাহাড়ি ঢাল। এমনই এক ট্রেকিং পথ ধরে পৌঁছতে হয় ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স। কপাল খারাপ বা ভালো থাকলে এখানে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের পাশাপাশি এখানে এশিয় কালো ভল্লুক, স্নো লেপার্ড, লাল শেয়াল বা বিভিন্ন বিরল প্রজাতির হরিণের মুখোমুখি হয়ে যেতে পারেন। তবুও প্রতি বছর পাহাড়ি এই ট্রেকিং পথে বহু মানুষ আসেন রোমাঞ্চ ও প্রকৃতির টানে। আর একদল মানুষ আসেন তাঁদের ধর্মীয় আচার পালন করতে। কারণ এই ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স পেরিয়েই যেতে হয় পবিত্র হেমকুণ্ড সাহিব। যা শিখ ও হিন্দুদের কাছে অতি পবিত্র তীর্থস্থান।
ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স যেতে হলে আপনাকে আসতে হবে হরিদ্বার বা হৃষিকেশ। কলকাতা বা হাওড়া থেকে এই দুই শহরে সরাসরি ট্রেন চলে। হৃষিকেশ থেকে বাসে বা ছোট গাড়িতে যেতে হবে যোশীমঠ। সড়ক পথে দূরত্ব প্রায় ২৫৫ কিলোমিটার এবং সময় লাগবে ৯-১০ ঘণ্টা। রাতটুকু যোশীমঠে কাটিয়ে পর দিন ভোরে রওনা দিন গোবিন্দঘাটের দিকে। গাড়িতে যোশীমঠ থেকে গোবিন্দঘাটের দূরত্ব মাত্র ২২ কিলোমিটার। আর এই গোবিন্দঘাট থেকেই শুরু পায়ে হাঁটা বা ট্রেকিং পথের। প্রথম দিন হাঁটুন ১০ কিমি মতো। গোবিন্দঘাট থেকে ঘনগরিয়া পর্যন্ত। এই পথ ট্রেক করতে সময় লেগে যাবে প্রায় ৬-৭ ঘণ্টা। কারণ, একধাক্কায় আপনাকে উঠতে হবে প্রায় ১২০০ মিটার উঁচুতে। এই পথের সবচেয়ে কঠিন চড়াই এইটুকুই। ঘনগরিয়ায় একরাত বিশ্রাম নিয়ে পরদিন মাত্র ঘণ্টা দুই-তিন ট্রেক করে পৌঁছে যান ফুলো কি ঘাঁটিতে।
প্রতি বছর ১ জুন থেকে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত এই পথ পর্যটক, তীর্থযাত্রী এবং ট্রেকার্সদের জন্য খোলা থাকে। এই সময় ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্সে প্রায় প্রতিটি গাছই ঢাকা পড়ে যায় অসংখ্যা ফুলে। যে এক নৈস্বর্গিক দৃশ্য। চারিদিকে নাম না জানা বাহারি ফুল। গোটা উপত্যাকা যেন একটা রঙ-বেরঙের ক্যানভাস। ঘাসেও ফুটে থাকে অসংখ্য ফুল। যেন আপনি ফুলের মেলায় হাজির হয়েছেন। জানা যায়, প্রায় ৬০০ প্রজাতির ফুল ফোটে এই ফুলের উপত্যকায়। সেই সঙ্গে অসংখ্য রঙিন প্রজাপতিও দেখতে পাবেন এখানে। অসংখ্য ফুলে ভরা গাছপালা, নদী, ঝর্ণার মধ্য দিয়ে পায়ে হাঁটা রাস্তা। কিছুটা কঠিন চড়াই হলেও আপনার ক্লান্তি কমিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হওয়ার জন্য এখানে থাকার কোনও ব্যবস্থা নেই। তাই বিকেল পাঁচটার মধ্যে আপনাকে নেমে আসতে হবে। এখানে কোনও দোকানপাট পাবেন না। তাই জল এবং শুকনো খাবার নিয়ে যেতে হবে।
ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স থেকেও অনেকটা উঁচুতে শিখদের পবিত্র ধর্মস্থান হেমকুণ্ড সাহিব। ফলে এই ট্রেক আরও কঠিন। তবে যারা এখানে যেতে চান, তাঁরা সোজা হেমকুণ্ড সাহিব চলে যাবেন প্রথমে। কারণ, দুর্গমতা এবং প্রচন্ড ঠান্ডার কারণে এই তীর্থস্থান দুপুর দুটোয় বন্ধ হয়ে যায়। কথিত আছে এখানেই শিখ ধর্মগুরু গোবিন্দ সিং ধ্যান করেছিলেন। এর উচ্চতা ৪,৩৩০ মিটার। এখানে একটি হ্রদ হয়েছে, যাকে হেমকুণ্ড বলা হয়। বছরের বেশিরভাগ সময়ই এই হ্রদটি বরফের চাদরে ঢাকা থাকে।
Discussion about this post