রবিবারের বিকেলে হওয়ার কথা ছিল ঐতিহ্যের ডার্বি। কিন্তু বিধাননগর পুলিশের অবিশ্বাস্য এক দাবিতে ডুরান্ড কমিটি বাতিল করে দেয় ডার্বি ম্যাচ। বিধাননগর পুলিশের ডিসি অনীশ সরকার প্রথমে এক সাংবাদিক সম্মেলন করে দাবি করেন, ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান ম্যাচের দিন গ্যালারিতে হামলা হতে পারে। দুটি অডিও ক্লিপ শেয়ার করে গ্যালারিতে হামলার ছক কষা হচ্ছে।
যুযুধান দুই দলের সমর্থকদের দাবি ছিল, প্রতিবাদের ভয়েই ডার্বি বাতিল করা হয়েছে। কারণ আর জি কর কাণ্ড নিয়ে, দুই দলের সমর্থকরাই তৈরি হয়েছিলেন গ্যালারিতে একযোগে আওয়াজ তুলবেন। ম্যাচ বাতিল হওয়ার তা ভেস্তে দেওয়া যাবে। কিন্তু এতকিছুর পরও দমানো যায়নি দুই দলের সমর্থকদের। ঠিক হয় যুবভারতীর বাইরেই প্রতিবাদে সামিল হবেন ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের সমর্থকরা। যদিও এরপরেও সেই কর্মসূচিকে দমানোর একাধিক চেষ্টা হয়েছিল। দুই দলেরই সমর্থকদের অভিযোগ, ভয় দেখিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে অসংখ্য ফোন গিয়েছে যাতে রবিবার যুবভারতীতে জড়ো না হয়। কিন্তু রবিবাসরীয় সন্ধ্যে দেখল এক অভিনব প্রতিবাদ।
১৬ আগস্ট ঘটা করে খেলা হবে দিবস পালন করল শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূলের জেলা স্তরের নেতারা নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালন করলেন এই কর্মসূচি। এর ঠিক একদিন পরই অর্থাৎ ১৮ আগস্ট ছিল ঐতিহ্যর ডার্বি। ঐতিহাসিক ডুরান্ড কাপের একটি ম্যাচে সল্টলেক যুবভারতী স্টেডিয়ামে হওয়ার কথা ছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের খেলা। কিন্তু অবিশ্বাস্য কারণ দেখিয়ে ওই ম্যাচের আয়োজন করা নিয়ে আপত্তি জানায় বিধাননগর কমিশনারেট। যুবভারতীর আশেপাশে দন্ড সংহিতার ১৬৩ ধারা জারি করা হয়, অর্থাৎ পূর্বতন ১৪৪ ধারা। তবুও দমানো যাইনি ইস্ট-মোহন সমর্থকদের। আরজি করে কর্তব্যরত চিকিৎসকের ধর্ষণ করে খুনের ঘটনার প্রতিবাদে সামিল হতে রবিবার বিকেল থেকেই জড়ো HOTE শুরু করেন হাজার হাজার সমর্থক। মাস খানেক আগেই মোহন-ইস্ট ডার্বির শততম ম্যাচটি হয়েছে। আবার ঐতিহাসিক এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার এটা ১০০ বছরও বটে। আর এই বছরই গোটা বিশ্ব দেখলো এক অদ্ভুত মেলবন্ধন। যাবতীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুবভারতীর দিকে এগিয়ে চলেছে একের পর এক মিছিল। কারও গায়ে ইস্টবেঙ্গলের লাল-হলুদ জার্সি, হাতে মোহনবাগানের সবুজ মেরুন পতাকা, আবার মোহনবাগানের জার্সি পড়া যুবকের কাঁধে চেপে বসেছেন লাল হলুদ জার্সি পড়া ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। এই ধরণের দৃশ্য বিগত ১০০ বছরেও কেউ দেখেনি।
যুবভারতী স্টেডিয়ামের বাইরে পুলিশবাহিনীর মোতায়েন ছিল অভূতপূর্ব। পুলিশি নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে যেখানে ডার্বি ম্যাচ বাতিল হল, সেখানে কয়েক হাজার পুলিশ, RAF সাজসজ্জা সহ দাঁড়িয়ে। অপরদিকে সবাইকে অবাক করে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান সমর্থকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে একঝাঁক মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সমর্থক, তাঁদের হাতেও সাদা-কালো পতাকা। সবমিলিয়ে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য তখন যুবভারতী স্টেডিয়ামের আশেপাশে। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে গোটা ইএম বাইপাস। শান্তিপূর্ণভাবেই এগোছিল মিছিল। পুলিশ আটকায় ১৬৩ ধারা জারি রয়েছে এই অজুহাতে। কিন্তু প্রতিবাদে অনড় ফুটবলপ্রেমী জনতা। তাঁদের ক্ষোভ, এত পুলিশ কোথা থেকে এল? এত পুলিশ যদি ছিলই তখন ম্যাচ কেন বাতিল করা হল? এরপরই লাঠি উচিয়ে সমর্থকদের তাড়া করে পুলিশ। বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়। তবুও দমানো যায়নি, কিছুক্ষনের মধ্যেই ফের মিছিল করে এগোতে থাকেন প্রতিবাদে মুখর ফুটবল সমর্থকরা। তখন অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টি ভিজেই চলল বিক্ষোভ। স্তব্ধ ইএম বাইপাস তখন ইস্ট-মোহন ও মহমেডান সমর্থকদের দখলে। সমবেত কণ্ঠে কখনও জাতীয় সঙ্গীত গাইছেন, তো কখনও আর জি করের জন্য বিচার। পিছু হঠে পুলিশবাহিনী। চার ঘন্টার বেশি ইএম বাইপাস আটকে চলে বিক্ষোভ।
বিধাননগর পুলিশ যদিও দাবি করেছিল, গোপন সূত্রে মাঠে হামলা হওয়ার খবর এসেছিলো। তাই নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় ম্যাচ আয়োজন করা নিয়ে আপত্তি জানানো হয়েছিল। ম্যাচ বাতিল হওয়ার পরও যখন দুই দলের সমর্থকরা যুবভারতী চত্বরে জড়ো হওয়ার তোড়জোড় করছেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করছেন। তখনই অভিযোগ আসে, বিধাননগর পুলিশ, আসানসোল-দুর্গপুর পুলিশ, ব্যারাকপুর পুলিশের তরফে বহু ফোন গিয়েছে জমায়েত না করার জন্য। এমনকি পুলিশের তরফে হুমকিও দেওয়ার অভিযোগ করেছেন দুই দলের সমর্থকরা। এখানেই প্রশ্ন উঠছে গোয়েন্দা রিপোর্ট নিয়ে। দুটি অডিও ক্লিপেরে ওপর ভিত্তি করে বিধাননগর পুলিশ দাবি করেছিল জমায়েতে হিংসা হতে পারে। পুলিশ দুজনকে গ্রেফতারও করেছে। এরপরেও কেন এই প্রতিবাদ কর্মসূচি আটকানোর এত প্রচেষ্টা? যেখানে শান্তিপূর্ণ মিছিলে লাঠিচার্জ হল, তবুও একচুল বিশৃঙ্খল আচরণ করেননি ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান সমর্থকরা। বরং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাঁরা আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদ করলেন বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। তবে কী গোয়েন্দা রিপোর্ট ভুল ছিল? নাকি অন্য কোনও কারণ? এখন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন ফুটবলপ্রেমী জনতা।
Discussion about this post