আর জি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুন করার অপরাধে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই একজনকে গ্রেফতার করেছিল কলকাতা পুলিশ। দাবি করা হয়েছিল, সেই মূল অভিযুক্ত বা অপরাধী। কিন্তু তারপরও এই ঘটনায় কলকাতা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে একাধিক প্রশ্ন তুলেছিল কলকাতা হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট। পাশাপাশি নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশও পুলিশকে দুষছেন। আর জি কর হাসপাতালের জুনিয়র চিকিৎসকরা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে এবং নিরাপত্তাহীনতার দাবি তুলে কর্মবিরতিতে চলে গিয়েছে। এখানেই প্রশ্ন আসে, পুলিশ যদি মূল অভিযুক্তকে দ্রুততার সঙ্গে পাকরাও করে, তাহলে এত ক্ষোভ তৈরি হল কেন?
গত ৯ আগস্ট সকালে আর জি কর হাসপাতালের এমার্জেন্সি বিল্ডিংয়ের চারতলার সেমিনার রুমে এক মহিলা চিকিৎসকের দেহ পাওয়া যায়। তিনি ওই হাসপাতালে কাজ করার পাশাপাশি উচ্চতর ডিগ্রি কোর্স করছিলেন। এরপর ঘটনাপরম্পরা বলছে, দেহ উদ্ধার থেকে শুরু করে, শনাক্তকরণ, ময়নাতদন্ত করানো, দেহ হস্তান্তর এবং দাহ পর্যন্ত পুলিশ যে অতি তৎপরতা দেখিয়েছে। ঘটনাস্থলের স্থিতবস্থা বজার রাখতে সে রমক তৎপরতা দেখায়নি। এমনকি হাসপাতালের বহু পদাধিকারীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেনি পুলিশ। সিসিটিভি ফুটেজ এবং একটি ছেঁড়া হেডফোনের সূত্র ধরে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেই দায় সেরেছিল। কিন্তু কেন ধর্ষণ, কেন খুন, কিভাবে অছবা কার নির্দেশে বা মদতে ওই ব্যক্তি বিনা বাঁধায় চারতলার সেমিনার হলে পৌঁছে গেল সেটা নিয়ে কোনও আলোকপাত নেই। যা নিয়ে একাধিক প্রশ্ন তুলেছে উচ্চ আদালত। বিশেষ করে ক্রাইম সিন বা ঘটনাস্থল সুরক্ষিত রাখতে পুলিশ কি কি করেছিল সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্নচিহ্নের মুখে। এরপর আর জি কর হাসপাতালে জুনিয়র চিকিৎসকরা আন্দোলন শুরু করলে পুলিশ বাঁধা দিয়েছিল বলে অভিযোগ। এমনকি গত ১৪ আগস্ট মহিলাদের রাত দখল কর্মসূচির মাঝে আর জি কর হাসপাতালে দুষ্কৃতি হামলায় পুলিশের ভূমিকা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, “ডাল মে কুছ কালা হ্যায়”।
গত ১৪ আগস্ট রাত ১১টা ৫৫ মিনিট থেকে মহিলাদের রাত দখল কর্মসূচি ছিল আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে। সেই কর্মসূচি প্রত্যাশার চেয়েও অধিক মাত্রায় লোকসমাগম হয় গোটা কলকাতায়। লক্ষাধিক মহিলা এবং পুরুষ রাস্তায় নামেন শান্তিপূর্ণ মিছিল করে। কিন্তু ওই দিন রাতেই ঠিক ১২টা নাগাদ আর জি কর হাসপাতাল থেকে মিছিল কিছুটা দূরে যেতেই, ব্যারিকেড ভেঙে কিছু দুস্কৃতি ঢুকে পড়ে হাসপাতালের ভিতর। কার্যত বিনা বাধায় তাঁরা হাসপাতালের এমার্জেন্সি ওয়ার্ড, এক তলা এবং তিনতলার একাধিক ওয়ার্ডে ভাঙচুর চালায়। একাধিক ভাইরাল ভিডিওতে দেখা গিয়েছে তাঁদের মূল টার্গেট ছিল চারতলার সেমিনার হল। কিন্তু ভুল করে তাঁরা তিনতলায় ডেন্টাল বিভাগ ভাঙচুর করে আসে। এই ঘটনায় সারা দেশেই সাড়া পড়ে যায়। একটা বৃহত্তর স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলনের মধ্যে স্বাধীনতার মধ্যরাতে সরকারি হাসপাতাল কিভাবে এবং কেন ভাঙচুর হল? এই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে শুরু করে জনমানসে। পুলিশের ব্যাখ্যা ছিল, সে দিন মধ্যরাতে কম সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন থাকায় দুস্কৃতিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। পুলিশ আরও দাবি করেছিল, সেখানে মোতায়েন থাকা পুলিশকর্মীরা অপরিসীম ধৈর্য রাখায় গুলি চলেনি। কিন্তু পুলিশের এই ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারেননি অনেকে।
এরপরে গত ২৭ এবং ২৮ আগস্ট এই পুলিশকেই দেখা গেল অন্য ভূমিকায়। ২৭ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ ছাত্রা সমাজের ডাকা নবান্ন অভিযান ঠেকাতে রীতিমতো রণসাজে সেজেছিল পুলিশবাহিনী। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড করে, স্টিলের গার্ডরেল ঝালাই করে, কনটেনার দিয়ে রাস্তা আটকে নবান্ন অভিযান ব্যর্থ করতে উঠে পড়ে লেগেছিল পুলিশ। এরপরও ছাত্র সমাজের মিছিলে জলকামান, কাঁদানে গ্যাসের সেল ফাটানো এবং লাঠিচার্জও করে পুলিশ। ওই দিনই বিজেপির লালবাজার অভিযান ঘিরেও রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় লালবাজার চত্বর। পুলিশ সেখানেও কাঁদানে গ্যাসের সেল ছোড়ে, লাঠিচার্জও করে। নবান্ন অভিযান ঠেকাতে প্রায় ৬০০০ পুলিশকর্মী মোতায়েন করা হয়। এখানেই বিরোধীদের প্রশ্ন, যে পুলিশ আর জি করে হামলা ঠেকাতে পারল না, সেই পুলিশই নবান্ন অভিযান ঠেকাতে বজ্র আঁটুনির ব্যবস্থা করল। ২৮ আগস্ট ১২ ঘণ্টার বাংলা বনধ ডেকেছিল বিজেপি। অপরদিকে নবান্ন পরিস্কার জানিয়ে দেয় রাজ্যে কোনও ভাবেই বনধ হবে না। বুধবার সকাল থেকেই বনধের সমর্থনে রাস্তায় নামা বিজেপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় খণ্ডযুদ্ধ হল। অবরোধ তুলতে জায়গায় জায়গায় লাঠিচার্জ করল পুলিশ। আবার এই দিনই শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠনের প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুমতি দিয়ে দিল সেই পুলিশই। টিএমসিপি প্রতিষ্ঠা দিবসে ধর্মতলায় ভাষণ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের সর্বভারতীয় সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কয়েক হাজার টিএমসিপি সমর্থক জড়ো হয়েছিলেন এই অনুষ্ঠানে। পুলিশ সুষ্ঠভাবে সেই কর্মসূচি পরিচালনা করেছে। অথচ সেই পুলিশই বিরোধীদের কর্মসূচিতে ছাড়পত্র দিতে নারাজ গোলমালের আশঙ্কায়। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের এই দ্বিমুখী নীতি দেখে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কী ভিন্ন পটভূমিকায় পুলিশের ভূমিকাও পাল্টে যায়?
Discussion about this post